আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
সময়টা ২০১৫ সালের ৩১ জানুয়ারি সকাল। ভারতের কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রণালয় অনলাইনে পশ্চিমবঙ্গের সরিষাতলি কয়লাখনির নিলাম কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু এই নিলামে প্রত্যাশা অনুযায়ী সাড়া পাওয়া যায়নি।
পাঁচটি কোম্পানি নিলামে অংশ নেওয়ার যোগ্য ছিল। নিলাম শুরুর প্রায় ১ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট পর একটি কোম্পানি দর হাঁকে। আরেকটি কোম্পানি নামমাত্রভাবে ‘প্রতিযোগিতা’ করে। অপর তিনটি কোম্পানি নিলামে দরই হাঁকেনি।
নিলামে অংশ নেওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন পাঁচটির মধ্যে তিনটিই ছিল একই করপোরেট ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর কোম্পানি। এটির নাম আরপি-সঞ্জীব গোয়েঙ্কা (আরপিএসজি) গ্রুপ। আরপিএসজির কোম্পানি কলকাতা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই করপোরেশন (সিইএসসি) কয়লাখনিটির বরাদ্দ পায়।
আরপিএসজি ভারতের অন্যতম বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী। জ্বালানি, প্রযুক্তি, শিক্ষা, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন খাতে এই গোষ্ঠীর ব্যবসা রয়েছে।
এই নিলামের অভ্যন্তরীণ তথ্য অনেক দিন অপ্রকাশিত ছিল। এ বিষয়ে ভারতের কম্পটোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) নিরীক্ষার নথি হাতে পেয়েছে ভারত-ভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রতিষ্ঠান দ্য রিপোর্টার্স কালেকটিভ। কালেকটিভের সঙ্গে যুক্ত আছে আল-জাজিরা।
নথির তথ্য বলছে, সরিষাতলি কয়লাখনির অনলাইন নিলামে আরপিএসজির মালিকানাধীন তিন কোম্পানির মধ্যে একটি দরই হাঁকেনি। আরেকটি কোম্পানি নিলামের মাত্র দুই দিন আগে আরপিএসজির অন্তর্ভুক্ত হয়। এই কোম্পানি যে ইন্টারনেট প্রটোকল (আইপি) ঠিকানা ব্যবহার করে দরপত্র জমা দিয়েছিল, সেই একই ঠিকানা ব্যবহার করেছিল সিইএসসি।
অভ্যন্তরীণ তথ্য সামনে আসার পর নিলাম প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বলা হচ্ছে, নিলাম প্রক্রিয়ায় গোপনীয়তার শর্ত মানা হয়নি। নিলামে অংশগ্রহণকারী কোম্পানিগুলো পরস্পরের সঙ্গে যোগসাজশ করেছে। নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করেছে। ফলে এখানে একটা অনিয়ম হয়েছে।
সরিষাতলি কয়লাখনির লাইসেন্স ২০১৪ সাল পর্যন্ত সিইএসসির হাতে ছিল। সে বছরই ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০৩টি কয়লাখনির লাইসেন্স বাতিল করেন। এগুলোর মধ্যে সরিষাতলি কয়লাখনিও ছিল।
আদালতের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে, অবৈধভাবে খনিগুলোর লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। এটি ছিল ২ হাজার ২০০ কোটি ডলারের কয়লাখনি কেলেঙ্কারির অংশ, যা ভারতজুড়ে শোরগোল ফেলে দিয়েছিল।
দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ের কথা বলে ২০১৪ সালে ভারতের ক্ষমতায় আসে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি। মোদির সরকার ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতের মাধ্যমে পুনরায় নিলাম করে খনিগুলোর লাইসেন্স দেওয়ার ঘোষণা দেন।
তবে দ্য রিপোর্টার্স কালেকটিভের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মোদির সরকারের সময়ও কয়লাখনির নিলাম প্রক্রিয়ায় অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষতির বিষয়ে সিএজির সতর্কতাও উপেক্ষা করা হয়েছে।
কয়লাখনি বেসরকারি কোম্পানিকে দিতে মোদি সরকার যে নিলাম করেছিল, তার প্রথম ধাপেই ছিল সরিষাতলি। ২০১৬ সালের আগস্টে সিএজির কর্মকর্তারা কয়লাখনির ইলেকট্রনিক নিলামের বিষয়ে পার্লামেন্টে প্রতিবেদন জমা দেন। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, সরিষাতলিসহ ১১টি খনির নিলাম প্রক্রিয়ায় কার্যকর প্রতিযোগিতা ছিল না।
একটি নিলামকে তখনই সফল বলা যায়, যখন তাতে অংশগ্রহণকারী কোম্পানিগুলো পূর্ণ প্রতিযোগিতা করে। আর এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সর্বোচ্চ দর হাঁকা কোম্পানি বরাদ্দ পায়। এতে নিলামকারীও ন্যায্য মূল্য পায়। কিন্তু ভারতে এই কয়লাখনিগুলোর নিলামের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। একই ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর একাধিক কোম্পানি নিলামে অংশ নিয়েছে। তারা যোগসাজশ করে বরাদ্দ বাগিয়েছে। এর সুস্পষ্ট প্রমাণ সিএজি পেয়েছে।
পরবর্তী সময়ে মোদি সরকার অভ্যন্তরীণভাবে স্বীকার করে, সেই নিলামপ্রক্রিয়ায় অনিয়ম হয়েছিল। একপর্যায়ে নিয়ম সংশোধন করে সরকার। কিন্তু তার আগেই বেশির ভাগ ব্যবহার উপযোগী কয়লাখনির নিলাম সম্পন্ন হয়ে যায়। এই নিলামে বেশির ভাগ খনির লাইসেন্স পায় আরপিএসজির মতো বড় বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী। তারা এখনো এসব খনির কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
সামগ্রিক বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রণালয়, সিএজি ও আরপিএসজির বক্তব্য জানতে প্রশ্ন পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে কারও কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি।