আমাদের সাংবাদিকতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সংকট বহুলাংশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার অকার্যকারিতা ও দুর্বল গণতান্ত্রিক চর্চার সঙ্গে সম্পর্কিত। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক মহল অনেক সময়েই স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে রাষ্ট্র পরিচালনার সহায়ক শক্তি হিসেবে গ্রহণ করার পরিবর্তে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করছে। এই বিবেচনা থেকেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য প্রতিকূল ও সাংবাদিকদের জন্য বিপজ্জনক কালাকানুন প্রণয়ন করা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ব্যাপক সমালোচনার মুখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে অধিকতর কঠোর আইন প্রণয়ন ও তার অপপ্রয়োগের অন্য কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।
স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে যত রকমের বাধাবিপত্তি কল্পনীয় হতে পারে, তার প্রায় সব উদাহরণই বাংলাদেশে রয়েছে। জাতীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকের বিরুদ্ধে ৭০-৮০টি মামলা দায়ের করার (এবং হয়রানিমূলক জেনেও সেসব মামলা বিচার্য বলে গৃহীত হওয়া) দৃষ্টান্ত থেকেই বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিবেশ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা মেলে। সরকার যা–ই বলুক, দেশে এবং দেশের বাইরে সংশ্লিষ্ট সবাই বাংলাদেশের গণমাধ্যমের এই বাস্তবতা সম্পর্কে অবহিত। একটি পত্রিকা হিসেবে প্রথম আলোর অভিজ্ঞতা তাই। কয়েক বছর ধরে সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ থেকে শুরু করে নানা ধরনের বাধা ও হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছে প্রথম আলো। স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করতে নানা কৌশল নেওয়া হচ্ছে।
চলমান করোনা সংকটের কালে সংবাদমাধ্যম যখন ওয়াচডগের ভূমিকা পালনের চেষ্টা করছে; যখন সঠিক ও পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করার মাধ্যমে এই সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা পালনে তৎপর, তখনো তাদের সামনে নানা রকমের বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি করা হচ্ছে। ত্রাণসামগ্রী বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে সংবাদ পরিবেশনের দায়ে দুজন সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা
হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ৫ এপ্রিলে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে মোট ৫১ জন সাংবাদিক বিভিন্ন পর্যায়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন। কোভিড-১৯ সম্পর্কিত সরকারি প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে। কারণ, দুই কর্তৃপক্ষের দুই রকম ভাষ্য নিয়ে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন তুলেছিলেন।
দুর্ভিক্ষ, মহামারি ও অন্যান্য জাতীয় দুর্যোগের সময় অবাধ তথ্যপ্রবাহের গুরুত্ব আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু আমাদের দেশে ভিন্ন প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সরকারের নেতারা সম্ভবত ভুলে গেছেন যে বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইন নামে একটি আইন বলবৎ আছে, যার অনেকগুলো ধারা এই মুহূর্তে সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের দ্বারা লঙ্ঘিত হচ্ছে। করোনা-সংক্রান্ত সব তথ্য সঠিকভাবে জনসমক্ষে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে প্রকাশ করার বিধান অনুসরণ এবং সংবাদ ও মতপ্রকাশের মুক্ত পরিবেশের পথ সুগম করা এই মুহূর্তে একান্ত জরুরি। এই সংকট মোকাবিলায় সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মহলের তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করার জরুরি বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিচার করার বিকল্প নেই। সূত্র: প্রথমআলো