
আকরামুল ইসলাম: আওয়ামী লীগের শোকজ নোটিশকে কেন্দ্র করে দলীয় প্রতিপক্ষরা হয়ে উঠেছেন সক্রিয়। যে কোনভাবেই দল থেকে তাদের মাইনাস করতে মরিয়া এসব নেতারা। তবে ভিন্ন চিত্র তৃণমূলে। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের অভিমত এরাই প্রকৃত ত্যাগী, পরিক্ষীত ও জনপ্রিয়। আর জনপ্রিয়তার কারণেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে, উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভ করেন তারা।
২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ফলে আওয়ামী লীগের অন্দরমহলের মধ্যেই চলে প্রতিযোগিতা। এর মধ্যে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে যান সাতক্ষীরার সাত উপজেলার সাতজন প্রতিনিধি। অন্যদিকে, বিদ্রোহী হয়েও, নির্বাচনে অংশগ্রহন করেন আওয়ামী লীগের বঞ্চিত বাকি নেতারা।
এর মধ্যে কলারোয়া ও কালিগঞ্জ উপজেলায় বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেন, দুই উপজেলার বিদ্রোহী আওয়ামী লীগের দুই সাধারণ সম্পাদক। আর কারচুপির কারণে জয়লাভ করতে পারেননি আশাশুনি আওয়ামী লীগ নেতা শহিদুল ইসলাম (পিন্টু)।
উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এসব নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় দল থেকে তাদের শোকজ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে শোকজের ব্যাখ্যা দিয়েছেন, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী নেতারা।
জানা গেছে, সম্প্রতি খুলনা বিভাগের বিভাগীয় সাংগঠনিক কমিটির সভা করেছে দলটি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় দলীয় এমপি, জেলা-উপজেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
মিটিং-এ সিদ্ধান্ত হয়েছে, উপজেলা নির্বাচনে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিল তারা আগামী সম্মেলনের প্রোগ্রামটির সভাপতিত্ব বা অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে পারবেন না। তবে প্রোগ্রামের আলোচনায় অংশ নিয়ে, নিজ নিজ বক্তব্য তুলে ধরতে পারবেন। তাছাড়া তারা সম্মেলনের পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারবেন কি-না, সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে জানিয়ে দেওয়া হবে। তবে সে বিষয়ে এখনো কোন নির্দেশনা দল থেকে জানানো হয়নি।
আওয়ামী লীগের এ সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছেন কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম লাল্টু। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে এ নেতা দলীয় নৌকার প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফিরোজ আহমেদ স্বপনকে হারিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিমত শীর্ষ এই নেতাকে দল থেকে মাইনাস করার পরিকল্পনা চলছে। তাকে দল থেকে মাইনাস করা হলে, কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যক্রম দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ও বাধাগ্রস্থ হবে।
এছাড়াও আশাশুনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম (পিন্টু)। তিনিও জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছেন। উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন। তবে তিনি জয়ী হতে পারেননি। এই নেতার অভিযোগ, কারচুপির মাধ্যমে তাকে হারানো হয়েছে। স্বচ্ছ ভোট হলে বিপুল ভোটে তিনি জয়লাভ করতে পারতেন।
অন্যদিকে, কালিগজ্ঞ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাঈদ মেহেদীও পড়েছেন বিপাকে। দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিদ্রোহী হয়ে, তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে জয়ী হন। উপজেলার শীর্ষ এই নেতাকে বাদ দিয়ে ইতোমধ্যে কালিগজ্ঞ উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন-এর প্রস্তুতি কমিটিও গঠন করেছে, জেলা কমিটি।
কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ডা. আব্দুল জব্বার, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ জাকির হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক ভিপি মোরশেদ জানান, উপজেলা নির্বাচনে দলীয় নেতাকর্মীদের (আন্তরিক ও ভালোবাসার) চাপে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন, সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম লাল্টু। তার জনপ্রিয়তার কারনেই বিপুল ভোটে সে জয়লাভ করে। সভাপতি ফিরোজ আহমেদ স্বপনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয় দলীয় ত্যাগী নেতাকর্মীরা। দলীয় সভানেত্রীর কাছে আমাদের দাবি থাকবে, মাঠের পরিক্ষীত নেতা আমিনুল ইসলাম লাল্টুকে মাইনাস করার যে ষড়যন্ত্র চলছে সেটি বাস্তবায়ন হলে দূর্ণীতিবাজ, স্বার্থান্বেষী নেতারাই লাভবান হবে।
নিজ অবস্থান তুলে ধরে কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম লাল্টু বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে নোটিশ দিয়েছেন। আমি গত ২৯ সেপ্টেম্বর শোকজ নোটিশের জবাব দিয়েছি। যারা শোকজ হয়েছে তাদের বাদ দিয়ে সম্মেলন করতে চায় সাতক্ষীরা জেলা কমিটি। কেন্দ্র বা জেলা থেকে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে, সে চিঠিতে দলীয় পদ এড্রেস করেই, চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমানে তারা যে কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেটি অসাংগঠনিক, অগণতান্ত্রিক পর্যায়ে পড়ে।
এই নেতা বলেন, নেত্রী যদি আমাকে বাদ দিতে চায়, তবে আমি সেটাকে আশির্বাদ হিসেবে গ্রহন করবো। তবে কিছু নেতা আমাকে সাইড করে দিতে চায়। সাইড করতে পারলে, তারা তাদের নিজ চরিতার্থে উপকৃত হবেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের ৭১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির ৩৮ জনই আমার পক্ষে রয়েছে। তারা জননেত্রীর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবে, তবে ষড়যন্ত্রকারীদের সিদ্ধান্ত মানবে না এবং রুখে দিবে।
নিজের অবস্থান তুলে ধরে আশাশুনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম (পিন্টু) বলেন, তৃণমূল নেতাকর্মীদের চাপের মুখে, আমি উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহন করি। পরবর্তীতে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়, আমি যদি মনোনয়ন প্রত্যাহার করি। তবে সকলে ভেবে নেবে, আমি এক কোটি টাকা নিয়ে নির্বাচন থেকে সরে গেছি। তখন এক প্রকার বাধ্য হয়েই নির্বাচনে অংশ লড়ে যেতে হয়। শতকরা ৯০ শতাংশ নেতাকর্মী আমার সঙ্গে ছিল বা আছেন। স্বচ্ছ নির্বাচন হলে নিশ্চিত জয়ী হতে পারতাম।
তিনি বলেন, দলীয় সাধারণ সম্পাদক একটা কথা বলেছিলেন, বিদ্রোহী হয়ে যারা মনোনয়ন নিচ্ছেন তারাও দলের লোক। এছাড়া অতীতে কারো বিরুদ্ধে এমন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যার কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি। এটা আমার ভুল হয়েছে। এসব উল্লেখ করেই আমি আমার শোকজের জবাব দিয়েছি।
আশাশুনি উপজেলা আওয়ামী লীগের এই সাধারণ সম্পাদক জানান, আমি দল থেকে বহিষ্কার হয়েছি এই মর্মে প্রচারণা চালাচ্ছে। আমাকে বাদ দিয়েই মিটিং,সহ সকল কার্যক্রম পরিচালনা করছে একটি গ্রুপ। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে সাকিল চেয়ারম্যানকে। বৃহস্পতিবার এর প্রতিবাদে আশাশুনি আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে আমরা প্রতিবাদ সভা করেছি। সেখানে কমিটির ৩২ নেতাকর্মী উপস্থিত ছিল। এছাড়া যৌথ সভার ডাক দেওয়া হয়েছে। সেখানেও আমরা যোগদান করবো। উপজেলা নির্বাচনের সময় যে সকল কেন্দ্রগুলোতে সুষ্ঠ ভোট হয়েছে সেসব কেন্দ্রগুলোতে আমি শতকারা ৮০ ভাগ ভোট পেয়েছি। জনবিচ্ছিন্ন সভাপতি পেয়েছেন ২০ ভাগ ভোট।
তবে উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহী হয়েও চিন্তামুক্ত রয়েছেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এস.এম শওকত হোসেন। তিনি বলেন, আমি তৃণমূলের ভোটে প্রথম হয়েছিলাম। জেলা থেকে কেন্দ্রে এক নম্বরে আমার নাম পাঠালেও কেন্দ্র আমাকে মনোনয়ন দেয়নি। নেতাকর্মীদের চাপের মুখে বিদ্রোহী হয়ে নির্বাচন করেছি। নির্বাচনে জয়লাভ করে আলহাজ্ব আসাদুজ্জামান বাবু আমার বাড়িতে এসেছিলেন। ভালো মনোভাব নিয়েছেন এসেছিলেন। আমাদের মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্ব সেটিরও অবসান হয়েছে। তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের দ্বিধাবিভক্তির অবসান ঘটেছে। দল থেকে পাওয়া শোক নোটিশের জবাব আমি দিয়েছি। এখন দল যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটিই চূড়ান্ত।
বিদ্রোহী এসব আওয়ামী লীগ নেতাদের বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনসুর আহম্মেদ বলেন, উপজেলা নির্বাচনে যারা বিরোধীতা করেছেন। তাদের দল থেকে শোকজ নোটিশ দিয়েছে। তারা নোটিশের জবাবও দিয়েছেন। এখনো তাদের বিষয়ে দল থেকে কোন নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে যেখানে নতুন কমিটি হচ্ছে, সেখানে বিদ্রোহীদের বাদ দেওয়া হচ্ছে।