আমার আজকের আলোচনার বিষয় বিশ্বকবির সঙ্গীত সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সামান্যে শেষ হবে না। তাই শুধু মাত্র সঙ্গীত বিষয়ের উপর দু-একটি কথা বলার চেষ্টা করছি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তিনি বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীত জগতের কালজয়ী মহাপুরুষ। তার সাথে মহাসাগরের তুলনা করা চলে। সুতরাং আমার মতো ক্ষুদ্র ব্যক্তি তার রচিত সঙ্গীত বিষয় নিয়ে আলোচনা করা মানে আস্ফালন দেখানো মাত্র। তিনি ইং ৭ই মে, ১৮৬১ খ্রিঃ ও বাং ২৫ শে বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দ কোলকাতার জোড়াসাকোর সম্ভ্রান্ত এক ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, উপন্যাসিক, ছোট গল্পকার ও শুধু নাট্যকর ছিলেন না, একই সাথে ছিলেন অভিনেতা, দার্শনিক ও সঙ্গীত রচয়িতা, সুরস্রষ্ঠা ও গায়ক। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার ছিল অবাদ বিচরণ। পিতামহ প্রিন্স দারকানাথ ঠাকুর ও পিতা মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অসাধারণ সাংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্ব। বিশ্বকবির পিতা কেন মহর্ষী হলেন তা পরবর্তী সংখ্যায় বর্ণনা করব। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিশোর বয়সের সঙ্গীত শিক্ষক ছিলেন যদু ভট্ট। তার কাছ থেকে বিশ্বকবি সঙ্গীতের বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞানলাভ করেন। সঙ্গীত শিক্ষক যদু ভট্টের অকাল মৃত্যুর কারণে সঙ্গীত শিক্ষার ক্ষেত্রে কবির একটু ছন্দপতন ঘটে। পরবর্তীতে সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে রাধিকা প্রসাদ গোস্বামীকে পেয়েছিলেন। এই রাধিকা প্রসাদ গোস্বামী বিশ্বকবিকে সঙ্গীত বিষয়ে পারদর্শী করে তোলেন। এই রাধিকা প্রসাদ গোস্বামীর ভাইপো ছিলেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ গোস্বামী। এই জ্ঞানেন্দ্রনাথ গোস্বামী রাগপ্রধান গানে অসাধারণ পারদর্শী ছিলেন। আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রচয়িতা বাংলা সাহিত্যের এই উজ্জ্বল ধ্রুব নক্ষত্র বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ষড়ঋতুর দেশ আমাদের বাংলাদেশ। ঋতু বদলের সাথে সাথে প্রকৃতি যেন তার রূপ বদলায়। এসব ঋতুর বর্ণনা দিয়ে কবি অনেক গান রচনা করে নিজে তার সুর দিয়েছেন। আবার বিভিন্ন পার্বনকে কেন্দ্র করে কবি অনেক গান রচনা করে, তার প্রত্যেকটি গানে সুরকার এবং গায়ক হিসেবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেছেন। তাঁর অনেক গানে আধ্যাত্মিকতার ছাপ ফুটে উঠেছে। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি, এ গানটি এত আপন করে বিভিন্ন ঋতুর পরিবর্তনের বর্ণনা দিয়ে, বাংলাদেশের দৃশ্য ও তার লেখনি ও মনভোলানো সুরের মাধ্যমে আমাদেরকে মোহিত করেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ গানটিতে এদেশের প্রকৃতি, মাটি ও মানুষের কথা লিখেছেন। এই গানের সুরের সাথে মিশে আছে বাংলাদেশের মন উদাস করা বাউল গানের সুর। প্রখ্যাত বাউল শিল্পী গগন হরকরার সেই গান আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে। এ গানটির সুরে মোহিত হয়ে কবি আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি, দেশপ্রেমের এ গানটি রচনা করে, তিনি এ গানটির সুর দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুুদ্ধে এ গানটি মুক্তির প্রেরণা যুগিয়েছিল। জাতির পিতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী এ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে পরবর্তীতে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সেই থেকে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বকবিকে যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কবির আরেকটি গানে আধ্যাত্মিকতার ছাপ ফুটে উঠেছে। যেমন, আমার হেয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি, তোমায় দেখতে আমি পাইনি। বাহির পানে চোখ মেলেছি আমার হৃদয় পানে চাইনি। কবি এখানে প্রকৃত মানুষের মনুষত্ব, বিবেক ও তার মানবিক সত্ত্বার কথা উল্লেখ করেছেন। আমি বাহির পানে চোখ মেলেছি হৃদয় পানে চাইনি। আমার মাঝে যে আমি আছে, অর্থাৎ মানুষের প্রকৃত বিবেক বা মনুষত্ব প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয়ে আছে, সেই হৃদয়ের পানে আমরা কখনও ফিরে তাকাইনি। কবি এখানে তার গানে মানুষের বিবেক ও মনুষত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। কবির আরেকটি গানের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। যদি না করি হয়তো আমার সঙ্গীত বিষয়ে লেখার স্বার্থকতা হবে না। গানটির কথা- যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে। মূলত এই গানটি রচনা করেছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন যখন প্রকট আকার ধারণ করেছে, স্বাধীনতার জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিপ্লবীরা যখন আপ্রাণ লড়াই করে যাচ্ছেন, তাদের মনোবল অটুট রাখার জন্য বা মনে সাহস যোগানোর জন্য প্রকৃত অর্থে এগানটি তিনি রচনা করেছিলেন। তারপরও গানটি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সমাজের জন্য প্রযোজ্য বলে আমি মনে করি। কবি এখানে বলতে চেয়েছেন, তুমি বা তোমরা সত্যের পথ অনুসরণ করার জন্য, ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর জন্য, আত্মার বা নিজের উপর বিশ্বাস রেখে, সম্মুখে যত বাধা বিপত্তি আসুক না কেন, সব কিছু অতিক্রম করে সত্য এবং ন্যায়ের পথ ধরে সম্মুখ পানে এগিয়ে যাবে। কখনো পিছন ফিরে তাকাবে না। সবাই যদি সত্য বা ন্যায়ের পথ অনুসরণ করতে বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ভয় পায়, তাহলে বুকে সাহস নিয়ে অন্ধকারে বুকের পাজর জ্বালিয়ে তুমি সম্মুখ পানে অগ্রসর হবে। সমাজে অনেক মানুষ আছে যারা ভীরু, কাপুরুষ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস টুকু হারিয়ে ফেলেছে। ন্যায়ের বা সত্যের পথে চলতে তারা ভয় পায়। এদের মেরুদন্ড থাকলেও মেরুদন্ডহীন প্রাণীর মতো নিজেকে সমাজ থেকে গুটিয়ে নিয়েছে। কবির কথায় বলতে হয়, এরা সমাজে আধমরা। কবি এখানে তার গানের মাধ্যমে এই সমস্ত ভীরু, কাপুরুষদের মেরুদন্ড সোজা করে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর সাহস যুগিয়েছেন। বিশ্বকবির গানের সংখ্যাা অনেক। সেই গানের ভিতর থেকে মাত্র ৩টি গান নিয়ে আলোচনা করলাম। রবীন্দ্রনাথের গানের সংখ্যা ২২৩২ টি, তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতার সংকলন গীতাঞ্জলী। এই গীতাঞ্জলী গীতিকবিতার জন্য ১৯১৩ সালে সাহিত্যে তাকে সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করা হয়, অর্থাৎ নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়। এখানে আরেকটি বিষয় আছে, কবির লেখা উক্ত গানগুলি তিনি নিজেই সুর করেছেন। কবির গানের গলা ছিল অসাধারণ। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক। বাংলা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তার গান বা গানের কথা ও সুর হৃদয় দিয়ে শুনলে বা অনুভব করলে তুমি নিজেকে একজন খাটি মানুষ হিসেবে অবশ্যই সমাজে একদিন আত্মপ্রকাশ করবে। তোমার মধ্যে থাকবে না অহংকার, থাকবে না কোন সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে থাকবেনা কোন বিভেদ। বুকে আসবে সাহস, মনে আসবে বল। শত দুঃখেও তোমাকে টলাতে পারবে না। বরং সামনে চলার পথ দেখাবে। ফিরে আসবে বিবেক, আসবে তোমার মনুষ্যত্ব। বাংলা সাহিত্য বা সঙ্গীতে তিনি একমাত্র কবি, যিনি বিশ্ব দরবারে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতকে যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অবশেষে কবি ইং ৭ই আগস্ট, ১৯৪১ খ্রিঃ ও বাংলা ২২ শে শ্রাবন, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মহাকাশ থেকে যেন একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের ছন্দপতন ঘটল। তার মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য এবং সঙ্গীতের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন হলো। যা কখনও পূরণ হওয়ার নয়। তবুও মহান স্রষ্টার নিয়ম অনুযায়ী জন্মিলে তো মরতে অবশ্যই হবে। এ নিয়ম শুধু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রে নয়, সকলের বেলায় প্রযোজ্য। তবুও এই দুদিনের দুনিয়ায় পৃথিবীতে এসে তিনি যা সৃষ্টি করে রেখে গেলেন তা পৃথিবীর মানুষ সহ তথা বাঙালী, বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীত যতদিন থাকবে, ইতিহাসের পাতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক