শ্যামনগর প্রতিনিধি: সুন্দরবনে অপরাধ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছে, সুন্দরবন সুরক্ষিত করতে হলে প্রয়োজনীয় জনবল লাগবে। কিন্তু খুলনা অঞ্চলের সুন্দরবন বিভাগে জনবলের চিত্র হতাশাজনক। ১ হাজার ১৯০টি মঞ্জুরিকৃত পদের বিপরীতে শূন্য রয়েছে ৩২৩টি। সবচেয়ে বেশি শূন্য রয়েছে ফরেস্ট ও ডেপুটি রেঞ্জার, ফরেস্টার, সারেং, নৌকাচালক ও ইঞ্জিনম্যান পদ। ফরেস্ট রেঞ্জার ৩০ জনের ২৭ জন থাকলেও ডেপুটি রেঞ্জার পদে ৪৫ জনের একজনও নেই। বিশেষজ্ঞ ও বন সংশ্লিষ্টদের অভিমত, জনবল সংকটে কার্যত সুরক্ষা পাচ্ছে না ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। বাঘ, হরিণ, মাছ শিকারসহ নানা অপরাধের ঘটনা ঘটছে। জনবল অপ্রতুল হলেও নানা কর্মকা-ের মাধ্যমে তারা অপরাধ দমনে চেষ্টা করছেন বলে বন কর্মকর্তারা জানান। বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রথম শ্রেণির মধ্যে উপবন সংরক্ষকের ৩টি পদের মধ্যে ১টি ও সহকারী বন সংরক্ষকের ৮টি পদের মধ্যে ৩টি শূন্য রয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণির মধ্যে ফরেস্ট রেঞ্জারের ৩০টি পদের ২৭টিই শূন্য। তৃতীয় শ্রেণির মধ্যে মেকানিক্যাল সুপারভাইজারের ১টি পদের ১টি, ফোরম্যানের ২টি পদের মধ্যে ২টি, ইঞ্জিন ড্রাইভারের ৩১টি পদের ১৪টি, হিসাবরক্ষকের ৩টি পদের ১টি, ডেপুটি রেঞ্জারের ৪৫টি পদের ৪৫টি, উচ্চমান সহকারীর ৩টি পদের ১টি, ফরেস্টারের ১০৮টি পদের ৪৩টি, সারেংয়ের ১৭টি পদের ১৩টি, ড্রাফটম্যানের ২টি পদের ২টি, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটরের ১৭টি পদের ৫টি, টার্নারের ২টি পদের ১টি, কার্পেন্টারের ৩টি পদের ৩টি, ড্রাইভারের ৫টি পদের ১টি ও কর্মকারের ২টি পদের ১টি খালি রয়েছে। চতুর্থ শ্রেণির মধ্যে ক্যাশ সরকারের ১টি পদের ১টি, সুকানির ৬টি পদের ৬টি, ডেসপাস রাইডারের ২টি পদের ১টি, বন প্রহরীর ১৯৫টি পদের ৭টি, অফিস সহায়ক ২৮টি পদের ৫টি, নিরাপত্তা প্রহরীর ৫টি পদের ১টি, পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ৫টি পদের ২টি, নৌকাচালক ৫৪৬টি পদের ১২৩টি, টেন্ডলের ৫টি পদের ১টি, ডেক ক্যাশবের ৩টি পদের ১টি, টেন্ডল স্টোকারের ২টি পদের ১টি, খালাসির ৪৩টি পদের ৭টি ও বাবুর্চির ২টি পদের ১টি শূন্য রয়েছে। বন সংশ্লিষ্টরা জানান, জনবল সংকটের কারণে বাঘ, হরিণ ও মাছ শিকারসহ নানা অপরাধ ঘটছে। বন্যপ্রাণী পাচার, অবৈধভাবে বনে প্রবেশ, চোরাচালান, আগুন লাগানো ও বনজ সম্পদ ধ্বংস ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে বন বিভাগ। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ৬ ফেব্রুয়ারি র্যাব-৬ অভিযান চালিয়ে সুন্দরবনের শিকার নিষিদ্ধ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া উদ্ধার করে। সাতক্ষীরায় শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের হরিনগর বাজারসংলগ্ন ধলপাড়া গ্রামের শেখ হাফিজুর রহমানের বাড়ি থেকে বাঘের ওই চামড়া উদ্ধার করা হয়। আগের দিন রাতে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ইসহাকের ছিলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২০ কেজি মাংস জব্দ করা হয়। এ ছাড়া চলতি বছর ২৯ জানুয়ারি সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জে শিকারিদের কবল থেকে ৪৬ কেজি হরিণের মাংস, চারটি চামড়া, হরিণ ধরার ফাঁদ ও বন্দুকের গুলি উদ্ধার করেন বনরক্ষীরা। এর আগে গত বছর ২১ আগস্ট সুন্দরবনের গঙ্গাচরণ এলাকায় অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে শিকার করা ১১ কেজি মাংসসহ দুটি হরিণের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উদ্ধার করেন কয়রা কোস্টগার্ড স্টেশনের সদস্যরা। এ ছাড়া গত বছরের ২৪ মার্চ সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের আংটিহারা এলাকা থেকে ৮২ কেজি হরিণের মাংস ও ২০টি পা জব্দ করেছে কোস্টগার্ড। এছাড়া চলতি বছরের জুন মাস হইতে অদ্যবতী পর্যন্ত বনবিভাগ ও আন্টি হারা কোর্স গার্ড উপকূলীয় এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রায় ১২০ কেজি হরিণের মাংস মাথা চামড়া আটক করেছে এসময় এর সাথে জড়িত থাকা বেশ কয়েকজন কে আটক করে বিভাগীয় বন মামলা দিয়েছে বিশেষ করে এই সমস্ত অপরাধ গুলো উপকূলীয় অঞ্চলের কয়রা উপজেলার জসিং, আন্টি হারা, ঘড়িলাল, হরিয়ারপুর, শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পার্সে মারি, গাগড়ামারি নাপিতখালী, চাঁদনী মুখা, বুড়ি গোয়ালিনী, দাতিনা খালি, পানখালি, মুন্সিগঞ্জ, মৌখালী, হরিনগর, সিংহড় তলী, চুনকুড়ি, মীর গাং, টেংরাখালি, কালিঞ্জছে,গোলা খালি, ও কৈ খালি তে বেশি ঘটছে।এক মাএ কারন বন বিভাগের জনবল সঙ্কট। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক এস এম রুবায়ত আব্দুল্লাহ এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সুন্দরবন সুরক্ষায় জনবল গুরুত্বপূর্ণ। জনবল কম থাকলে অনেক সময় অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে। এক স্থান থেকে অন্যস্থান নিয়ন্ত্রণ সহজে করা যায় না। তবে অপরাধ কমাতে জনবল বৃদ্ধির পাশাপাশি লজিস্টিক সাপোর্টও প্রয়োজন। এ ছাড়া সুন্দরবন রক্ষায় যারা নিয়োজিত থাকেন তাদের মধ্যে অবশ্যই সততা থাকতে হবে। তাহালেই কেবল সম্ভব হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সুন্দরবনে অপরাধ বাড়ার পেছনে দারিদ্র্য অনেকাংশে দায়ী। অর্থনীতি খারাপ হলে অভাবে আশপাশের মানুষ অবৈধভাবে বনে প্রবেশ করে চোরাচালানসহ নানা অপরাধে লিপ্ত হয়।’ সুন্দরবনের অপরাধ সম্পর্কে পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা নুরুল করিম বলেন, সুন্দরবনে স্মার্ট প্যাট্রলিং কার্যক্রম চলছে। সুন্দরবন সংলগ্ন জনগোষ্ঠীর সচেতনতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং অপরাধ উদঘাটনকারী ও তথ্য প্রদানকারীকে পুরস্কারও দেওয়া হচ্ছে। সে কারণে বাঘ, হরিণ, মাছ শিকার ও চোরাচালানের ঘটনা আগের তুলনায় কমে গেছে। খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, প্রতিনিয়ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবসরে যাচ্ছেন। সে কারণে লোকবল সংকট দেখা দিয়েছে। অপ্রতুল জনবল দিয়ে সুন্দরবনে চুরিসহ নানা জটিলতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। শূন্য পদে দ্রুত জনবল নিয়োগ হওয়া দরকার। তিনি আরও বলেন, বাঘ, হরিণ ও মাছ শিকারসহ নানা অপরাধ ঘটে। কিন্তু সেগুলো নিয়ন্ত্রণে নানা কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। এখন আগের তুলনায় কমে এসেছে।