- মৎস্যঘেরে পানি দিয়ে বাণিজ্য
- পানি বঞ্চিত শত শত মৎস্যজীবী
- বর্ষায় প্লাবিত হয়ে ব্যাপক মৎস্য ও ফসলহানী
- মেম্বর বাবু ও মুনছুর সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে
নিজস্ব প্রতিবেদক: কালিগঞ্জ উপজেলার রতনপুর ও মথুরেশপুর ইউনিয়নে প্রবহমান গড়ুইমহল খালে বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করার অভিযোগ উঠেছে কালিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদীর বিরুদ্ধে। বাঁধ দিয়ে পানি আটকে দিয়ে সেই পানি বিঘা প্রতি ৪০০-৫০০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে মৎস্য চাষিদের নিকট। অভিযোগ রয়েছে, পানি বিক্রয় ও টাকা উত্তোলনের জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান গড়ে তুলেছেন বিশাল সিন্ডিকেট। এদিকে পানি প্রবাহ বন্ধ থাকায় নাব্যতা সংকটে পড়েছে পার্শ্ববর্তী মহেষকুড় খাল। খালের তলদেশ ভরাট হয়ে পার্শ্ববর্তী ফসলি মাঠ ও মৎস্য ঘেরের সমান্তরাল হয়ে পড়েছে খালের গভীরতা এবং খালটিতে গভীরতা না থাকার ফলে এক বিন্দু পানিও নেই মহেষকুড় খালে। মহেষকুড় খালের এ বেহাল দশার কারণে এর দুই পাশের মহেষকুড়, দুদলি ও রায়পুর বিলের মৎস্য চাষিরা পড়েছেন চরম বিপাকে। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে স্থানীয়রা বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেও কোন সুফল পাননি। উল্টো রোষানলে পড়তে হয়েছে চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদী ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা যায়, কালিগঞ্জ উপজেলার আদি যমুনা নদী থেকে একটি উপ শাখা নদী দুদলি ও রায়পুর হয়ে মহেষকুড় বিলের মধ্যে প্রবেশ করে সমাপ্ত হয়। এই খালটি স্থানীয়দের কাছে পরিচিত মহেষকুড় খাল নামে। অপরদিকে কালিন্দী নদী থেকে একটি উপশাখা নদী গড়ুইমহল, নিজদেবপুর, গোয়ালপোতা ও খুব্দিপুর হয়ে মহেষকুড় নামক স্থানে মহেষকুড় খালের সাথে মিলিত হয়েছে। এই প্রবহমান খালটির পরিচিতি গড়ুইমহল খাল নামে। কয়েক বছর আগেও মহেষকুড় খাল ও গড়ুইমহল খাল দুইটি একটি ব্রিজের মাধ্যমে একসঙ্গে সংযুক্ত ছিল। দুই খালেই ছিল পানির পর্যাপ্ত প্রবাহ। স্থানীয়রা উন্মুক্ত খাল থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু বিধি বাম! সাঈদ মেহেদী কালিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরে চেহারা বদলে যায় খাল দুইটির। তাঁর নির্দেশেই গড়ুইমহল খাল ও মহেষকুড় খালের মোহনায় স্থায়ী বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে পানি প্রবাহ। অত:পর গড়ুইমহল, খুব্দিপুর, নিজদেবপুর ও গোয়ালপোতা বিলে কতিপয় মৎস্য চাষির কাছে বিঘা প্রতি ৪০০-৫০০ টাকা বাৎসরিক চুক্তিতে সেই পানি বিক্রি করছেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদী। জানা যায়, এসকল মৎস্য চাষিদের ঘেরে পানি সরবরাহ করা ও চুক্তির টাকা উত্তোলনের মূল দায়িত্ব পালন করেন রতনপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. বাবু গাজী। এবং এসকল কাজে সহযোগিতা করেন একই ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য গোয়ালপোতার গফুর সরদারের ছেলে জামায়াত নেতা মুনছুর সরদার, ২নং ওয়ার্ডেরর ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম, নৈহাটি গ্রামের আহম্মদ আলী পটোর ছেলে আফছার আলী, গড়ুইমহল গ্রামের মৃত: হযরত আলী গাজীর ছেলে আবু জাফর ও নিজদেবপুরের শাহদতের ছেলে তুহিন সহ আরো অনেকে। চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে উত্তোলনকৃত এসকল অর্থ ভাগ-বাটোয়ারা হয় বাবু মেম্বর, মুনছুর মেম্বর, সাইফুল মেম্বর, আফছার, আবু জাফর ও তুহিনের মধ্যে। যার বড় একটি অংশ পৌঁছে যায় উপজেলা চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদীর হাতে। অন্যদিকে, লোনা পানি ঢোকানোর ফলে গড়ুইমহল, গোয়ালপোতা, নিজদেবপুর ও খুব্দিপুর বিলে যারা মিঠা পানির মাছ চাষ ও ধান্য ফসল উৎপন্ন করেন তারা পড়েছেন চরম বিপাকে। চুইয়ে লোনা পানি প্রবেশ করায় ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন তারা। এছাড়া মোহনায় বাধ দেওয়ায় বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাসনের সুযোগ না থাকায় অতিরিক্ত পানি ওভারফ্লো হয়ে ভাসিয়ে নেয় হাজার হাজার বিঘার মৎস্য ঘের ও ফসলি জমি। তথাপিও কতিপয় লোনা পানির মাছ চাষিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অবৈধ আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে নিজের অবস্থান থেকে টলছেন না চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদী।
অন্যদিকে মহেষকুড় খালের অবস্থা আরো নাজুক। প্রবহমান খালটিকে এখন আর খাল না বলে সমতল ভূমি বলাই শ্রেয়। খালের কোথাও পানির চিহ্নমাত্র দেখা যায় না, কারণ খালের তলদেশ ভরাট হয়ে মাঠের সাথে মিশে গেছে। মহেষকুড় খালের এক অংশ মহেষকুড় বিলের মধ্যে এসে সমাপ্ত হওয়ায় এবং পানি প্রবাহ না থাকায় খালের পার্শ্ববর্তী জমির মালিকরা প্রতিবছর খালটির কিছু কিছু অংশ করে পর্যায়ক্রমে দখল করে ফেলছেন। তাছাড়া খালে পানি প্রবাহ না থাকায় উক্ত মহেষকুড়, দুদলি ও রায়পুর বিলের মৎস্য চাষিরা পানি সংকটে মৎস্য চাষ করতে পারছেন না। এসব বিলের ৭-৮ হাজার বিঘার মৎস্য ঘের প্রাকৃতিক পানি থেকে বঞ্চিত। তাই বাধ্য হয়ে মৎস্য চাষিরা অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা করেছেন তাদের ঘেরের জন্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মৎস্য চাষি সাতনদীকে বলেন, “গড়ুইমহল খাল ও মহেষকুড় খালের মোহনায় বাঁধ দেওয়ায় আমরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। উপজেলা চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদী নিজে উপস্থিত থেকে উক্ত স্থানে বাধ দিয়েছেন। আমাদের পানি নিতে হলে তাকে ও তার লোকদের টাকা দিতে হবে বলে। এ বিষয়ে আমরা কোন প্রতিবাদ করলে চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদী ও তার দলীয় লোকজন আমাদের মারপিট ও মিথ্যা মামলায় জড়ানোর হুমকি দেয়।”
সঙ্গত কারণে বাঁধ মুক্ত করার দাবীতে গত বছরের ১৪ আগস্ট মহেষকুড় গ্রামের আমিনুর রহমানের পুত্র ফিরোজ আহম্মেদ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিষয়টিকে নিয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দেন এসিল্যান্ডকে। কিন্তু সেখান থেকে কোন সুরাহা না মেলার কারণে ফিরোজ আহম্মেদ গত ১৫ই মে জেলা প্রশাসক, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পরিবেশ অধিদপ্তরে লিখিতভাবে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
বাঁধের বিষয়ে রতনপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলিম আল রাজি টোকন জানান, “ওখানে বাঁধের বিষয়টি আমি অবগত। প্রবহমান খালে বাঁধ দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও ওখানকার অনেক মৎস্য চাষিদের মাছ চাষের সুবিধার্থে বাঁধ দিয়েছেন। এতে করে মহেষকুড় খাল পানি বঞ্চিত হচ্ছে এবং ঐ বিলে যারা মিঠা পানির মাছ চাষ বা ফসল উৎপাদন করেন তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিষয়টির একটা স্থায়ী সুরাহা হওয়া উচিৎ।” বাঁধ দিয়ে পানি আটকে পানি বিক্রির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা আপনারা যেমন শুনেছেন আমিও শুনেছি ঘের মালিকদের কাছ থেকে টাকা উঠানো হয়।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কালিগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আজাহার আলী সাতনদীকে বলেন, “ওখানে একটি প্রবহমান খালে কে বা কারা বাধ দিয়েছিল। বিষয়টি আমরা জানার পর ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই স্থানীয়রা বাঁধটি কেটে দেয়। পরে আর কেউ বাঁধ দিয়েছে কিনা আমি জানি না। কেউ বাঁধ দিয়ে থাকলে তদন্ত পূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার রহিমা সুলতানা বুশরা সাতনদীকে বলেন, “প্রবহমান খালে বাঁধ দিয়ে পানি আটকানোর বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো।
এ বিষয়ে জানার জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদীর ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিক বার ফোন করা হলেও তিনি ফোনকল রিসিভ করেননি। ফলে এ বিষয়ে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয় নি।