
আব্দুল্লাহ্ আল মাহফুজ : অপরাধীদের কৌশলের কাছে অসহায় প্রশাসন। প্রতারনার নিত্য নতুন কৌশল হার মানিয়ে দিচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষদের। প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন অপকর্ম চললেও খবর রাখে না কেউ। কখনো পুলিশ কর্তা আবার কখনো সরকারি কোন কর্তা ব্যক্তির সঙ্গে ছবি তুলে প্রচারণা চালানো হয় ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে। আর তাতেই আকষ্ট হয় বিভিন্ন শ্রেণির মানুষরা। এবার শুরু হয় প্রতারণার ফাঁদ। ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেওয়া হয় লাখ লাখ টাকা। আর এ প্রতানার কাজে ব্যবহার করা হয় শহরের উঠতি বয়সী তরুনীদের। সম্মান আর পরিবারের কথা ভেবে সরকারি কর্মকর্তারা চাঁহিদামত টাকা দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। এমনই কর্মকাণ্ড চলছে সাতক্ষীরা সদর থানা থেকে মাত্র দুইশ গজ দূরে আর সিআইডি ও এনএসআই অফিসের দেড়শ গজ দূরত্বে। অফিস নিয়ে চলছে চাঁদাবাজি। সাইনবোর্ড ব্যবহার করা হয়েছে দৈনিক সাতক্ষীরা বার্তা নামের একটি অনলাইন পত্রিকার। সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিস সংলগ্ন একটি বাড়ির ফ্লাট ভাড়া চলছে এসব কার্যক্রম।
সাতক্ষীরার কালিগজ্ঞ উপজেলার রতনপুর এলাকার মৃত. অ্যাড. শামসুর রহমানের ছেলে কামরুল হাসান। শহরে পরিচিতজনদের কাছে টাউট-বাটপার হিসেবে পরিচিত। তবে এর বাইরে গিয়ে সাংবাদিক পরিচয়দানকারী কামরুল ইসলাম ফ্লাট নিয়ে সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহার করে চাঁদাবাজিসহ, তরুণী ব্যবহার করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ সাধারণ মানুষদের জিম্মি করে আদায় করেন মোটা অংকের টাকা। চাহিদামত টাকা না পেলেই শুরু হয় কাল্পনিক ও মনগড়া অভিযোগ নিয়ে নিজের অনলাইন পত্রিকায় সংবাদ।
কামরুল হাসানের একান্ত সহযোগী ও চাঁদার টাকা উত্তোলনকারী একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাতনদীকে জানান, দৈনিক সাতক্ষীরা বার্তা নামের নিজের অনলাইন পত্রিকার কার্ড বিক্রি করে টাকা উত্তোলন করে কামরুল। মাসিক যার কাছ থেকে যেমন নিতে পারে। প্রথমে প্রতিনিধির কার্ড বাবদ দিতে হয় দুই হাজার টাকা। মাসিক চাঁদার টাকা দিতে না পারলে অনলাইনে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বহিষ্কার করা হয় সেই প্রতিনিধিকে। কামরুল একাধিক নারী কেলেঙ্কারীর সঙ্গেও জড়িত। আসাদুল চেয়ারম্যান বিভিন্ন সময় নারী ঘটিত অপকর্মের মিমাংসাও করে দিয়েছে।
গড়ে তোলে জেলা রিপোর্টাস ইউনিট নামের সাংবাদিকদের নামধারী সংগঠণ। সেখানে সদস্য পদ দিতে শুরু করে মাসিক হারে চাঁদাবাজি। প্রতি সদস্য পদের জন্য ফরম ফি ৫শ টাকা। টাকার বিনিময়ে গঠণ করা হয় কমিটি। সভাপতি ও সম্পাদকের পদ দেওয়ার নাম করে তোলা হয় মোটা অংকের টাকা। পত্রিকা ও টিভিতে সংবাদ প্রকাশের ভয়ভীতি দেখিয়ে সাধারণ মানুষদের জিম্মি করা হয়। এরপর আদায় করা হয় চাঁদার টাকা। শহরের আবাসিক হোটেল, জেলার ইটভাটাগুলো থেকেও তোলা হয় মাসিক হারে টাকা, সরকারি কর্মকর্তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে আদায় করা হয় টাকা, জমি জায়গার বিরোধ মীমাংসার নামে নেওয়া হয় টাকা। এছাড়াও এসব কাজে ব্যবহার করা হয় উঠতি বয়সী বেশ কয়েকজন তরুণীকে। সরকারি কর্মকর্তা বা বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষদের কাছে প্রথমে পাঠনো হয় তরুনীকে। সেই তরুনী টিভির ইন্টারভিউ নেওয়া শেষ হলেই দাবি করা হয় মোটা অংকের টাকা। কখনো আবার চাঁদা আদায়ের জন্য তরুণীদের ব্যবহার করা হয় অসামাজিক কার্যকলাপে।
চাঁদাবাজ ও প্রতারক কামরুল হাসাসের ওই সহযোগী আরও জানান, সাতক্ষীরা জেলা রিপোর্টাস ইউনিটির নামে কামরুল ইসলাম প্রথম অফিস নেয় নতুন জর্জকোটের সামনে। সেখানেই শুরু হয় চাঁদাবাজির প্রথম ধাপ। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা নারীদের জিম্মি করে শুরু করে চাঁদা আদায়। চাহিদামত টাকা দিতে না পারায় গ্রামের নারীদের অনেক নারীদের কানের দুল এমনকি নাক ফুলও খুলে নিতে দেখেছি। এরপর অফিস চলে যায় কুলিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আসাদুল চেয়ারম্যানের শহরের সদর থানার পেছনের মার্কেটের দ্বিতীয় তলায়। সেখানে যাওয়ার পর পরিচয় ঘটে কিছু পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে। তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে শুরু নয় নতুনভাবে চাঁদাবাজি। সেখানেই অফিস থাকাকালীন সময়ে আসাদুল চেয়ারম্যানের ছেলে খোকার কাছ থেকেও প্রায় দুই লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।
এরপর অফিস নেয় খুলনা রোড মোড়ের শাকুড়া ভবনের তৃতীয় তলায়। সেখানে চাঁদাবাজি ও টাকা ইনকামের নতুন সুত্রের আবিষ্কার করেন তিনি। প্রতিনিধি নিয়োগ দিতে শুরু করেন টিভি চ্যানেল ও জাতীয় পত্রিকাগুলোর। টিভি চ্যানেলের প্রতিনিধি ৬০ হাজার টাকা আর জাতীয় পত্রিকার প্রতিনিধির জন্য ৫ হাজার টাকা। ৫০-৬০ জনের কাছ থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকা চাঁদাবাজি করে কামরুল। সেখানে তরুণী নিয়ে ফূতিও করে। ফূতিরত একটি ভিডিও ফুটেজও ছড়িয়ে পড়ে অনেকের মোবাইল ফোনে।
তিনি আরও বলেন, আমরা সামনেই নিয়েছে এসব হতে দেখেছি। এরপর অফিস চলে আসে সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিস সংলগ্ন একটি ভাড়া বাড়িতে। সেখানেই এখন চলছে চাঁদাবাজি। আমাকেও বিভিন্নস্থানে চাঁদার টাকা আনতে পাঠাতো কামরুল। তার বাড়ির ২১ হাজার টাকা মূল্যের এলইডি টেলিভিশনটি সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের এক কর্মকর্তার দেওয়া। হাসপাতালের স্টোর কিপার কামরুলকে জিম্মি করে ২১ হাজার টাকা আদায় করা হয়। নিজের অনলাইন পত্রিকায় চারজন তরুনীকে স্টাফ রিপোর্টার ও অপর দুইজন তরুনীকে নিজের একান্ত সহযোগী করে চাঁদার টাকা উত্তোলন করে। টাকা আদায়ের কৌশল হিসেবে সহযোগী তরুনীদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এক সময়ে চাহিদামত টাকা দিতে বাধ্য হয় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. হাফিজউল্লাহ স্বীকার হয়েছেন চাঁদাবাজ কামরুলের রোষানলের। সদর হাসপাতালের এই চিকিৎসক ডা. হাফিজউল্লাহ্ জানান, সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কিছুদিন আগে আমাকে ফোন দিয়ে চাঁদা চাইতে শুরু করে কামরুল। আমাকে বলতে থাকে, একজনকে পাঠাচ্ছি তার কাছে টাকা দিবেন। টাকা না দিলে আপনার বিরুদ্ধে সংবাদ করা হবে। পরবর্তীতে আমি টাকা না দেওয়ায় কাল্পনিক একটি সংবাদও অনলাইনে দিয়েছে। এরপর আমার দপ্তরে বেশ কয়েকজন সহযোগী নিয়ে হাজির হয় সাংবাদিক নামধারী কামরুল। এসেই টাকার দাবি করে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতে থাকে। ঘটনাটি অনেকেই জানেন।
শ্যামনগর উপজেলার উপকূলীয় বুড়িগোয়ালীনি ইউনিয়নের দাতিনাখালি গ্রামের আইয়ুব আলীর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা চুক্তি করেন তার জমির বিরোধ নিষ্পত্তি করে দিবেন কামরুল। হাতিয়ে নেন কয়েক লাখ টাকা।
কুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুল ইসলাম জানান, আমার ছেলে মাসুম বিল্লাহ্ খোকার কাছ থেকেও প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কমরুল। পাটকেলঘাটা প্রেসক্লাবের সভাপতি জহুরুল ইসলাম জানান, গত নির্বাচনের সময় টিভিতে প্রচারের নাম করে আমার কাছ থেকে তিন হাজার টাকা নিয়ে গেছে। প্রথমে প্রতারণার ঘটনা বুঝতে পারিনি। পরে আর আমার ফোন রিসিভ করেনি। একটি মেয়েকে নিয়ে এসে আমার কাছ থেকে বিজয় টিভির পরিচয় দিয়ে স্বাক্ষাতকার গ্রহন করে। বলে ওই তরুনী ঢাকা হেড অফিস থেকে এসেছে। পরে জানতে পারি বিজয় টিভির সঙ্গে প্রতারক কামরুলের কোন সম্পৃক্ততা নেই।
কুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুল ইসলামের ছেলে মাসুম বিল্লাহ্ খোকা জানান, আমাকে টিভি চ্যানেলের জেলা প্রতিনিধি করিয়ে দেওয়ার নাম করে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা নেয় প্রতারণার মাধ্যমে। পরে একটি ভূয়া টিভির কার্ড করে দেয়। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ দিলে এক লাখ ২০ হাজার টাকা ফিরিয়ে দিবে বলে অঙ্গীকার করে। এক তরুনীকে নিয়ে আপত্তিকর অবস্থায় হাতেনাতে ধরা পড়ার পর আমাদের মার্কেট থেকে প্রতারক কামরুলকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। আশাশুনির প্রতাপনগর এলাকার বাসিন্দা স্কেভেটর মেশিনচালক মূসার কাছে চাঁদা দাবি করতে কামরুলকে আটকিয়ে রাখে পরে আমি গিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসি। কামরুল তার মায়ের নামেও মামলা করেছে। একটা আস্ত টাউট লোক।