
মেহেদী হাসান, খুলনা থেকে:
২১ বছর বয়সী ভারতের মহারাষ্ট্রের শিক্ষার্থী রোহান আগারওয়াল এখন খুলনায়। পরিবেশ রক্ষা বিষয়ক বার্তা নিয়ে হেঁটে ১৬ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে খুলনায় এসেছেন তিনি। তিনি ভারতের গভর্নমেন্ট সিকিম প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটির স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
নিজ দেশের ২৭টি রাজ্যে সচেতনতাম‚লক প্রচারণা শেষে তিনি গত বছরের অক্টোবরে ফেনীর বিলোনিয়া চেকপোস্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। বাংলাদেশের ৪৫টি জেলা ঘুরে গত সোমবার (৬ মার্চ) রাতে খুলনায় আসেন তিনি। গত দুদিনে তিনি খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন।
বুধবার (৮ মার্চ) বিকেলে নগরীর শিববাড়ি মোড়ে পরিবেশ বিপর্যয় রোধে সচেতনতাম‚লক প্রচারণা করেন। এ সময় তিনি ‘শুধু ভারত বা বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের পরিবর্তন দরকার’, ‘একজন মানুষ পরিবেশে পরিবর্তন আনতে পারে না, আমাদের সবারই পরিবর্তন হওয়া উচিত, কারণ পরিবেশ সকলের’ ইত্যাদি লেখা সম্বলিত প্ল্যাকার্ড হাতে মানুষকে পরিবেশ বিষয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান।
রোহান আগারওয়াল বলেন, ২০২০ সালের ২৫ আগস্ট ভারতের মহারাষ্ট্র থেকে হাঁটা শুরু করি। সেখান থেকে নিজ দেশের ২৭টি রাজ্য হেঁটেছি। এই যাত্রায় আমার ম‚ল উদ্দেশ্য পরিবেশের বিষয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ানো। আমি মনে করি একজন মানুষ ছোট হোক, বড় হোক, ধনী বা গরিব হোক, কৃষক হোক বা ব্যবসায়ী প্রত্যেকেই জন্মের পর থেকেই পরিবেশ থেকে অক্সিজেন নেয়। আমরা যে খাবার খাই, পানি খাই সব কিছু প্রকৃতি থেকে আসে। অথচ তার পরিবর্তে আমরা পরিবেশ দ‚ষণ করছি। এই বিষয়টি বোঝা আজ খুবই জরুরি। কারণ আমরা যদি আজকে না বুঝি তাহলে আগামীতে খুবই সমস্যা হয়ে যাবে। ঘ‚র্ণিঝড়, বন্যাসহ যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসছে এগুলো আরও বেশি ভয়াবহ হবে। এ জন্য এসব বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে আমি এই যাত্রায় এসেছি। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে এই বিষয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছি। আমি ৯৪০ দিন এই যাত্রা করছি। ১৬ হাজার কিলোমিটার হেঁটেছি এবং কখনো কখনো লিফটও নিয়েছি। আমি ভ্যানের লিফট নিয়েছি। কিন্তু কোনো বাস-ট্রেনের লিফট নিইনি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় আমি যাব। এরপর আমি মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, মাকাও, সিঙ্গাপুর, চায়না, হংকং, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া ও সাইবেরিয়া যাওয়ার চেষ্টা করব। সাইবেরিয়ার ওমিয়াকোম পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম স্থান। যেখানে তাপমাত্রা মাইনাস ৭২ ডিগ্রি পর্যন্ত নেমে যায়। সাইবেরিয়া যাওয়ার জন্য আমার আরও ৫ বছর সময় লাগবে এই যাত্রা করতে। যদি আপনারা আমার এই যাত্রায় অংশ নিতে চান তাহলে আমার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে যুক্ত থাকবেন।
রোহান আগারওয়াল তার যাত্রার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, তিন বছর এই যাত্রা করছি। যাত্রায় কখনো ভালো মানুষের দেখা মেলে, আবার কখনো খারাপ মানুষের দেখা মেলে। কখনো কখনো না খেয়েও থাকতে হয়, আবার কখনো ডাকাতেরও দেখা মেলে। আলাদা ঘটনা ঘটে যাত্রায়। তবুও এই যাত্রা শেখার জন্য।
তিনি বলেন, যাত্রার শুরুর দিকে একবার ভারতের একটি স্থানে ডাকাতের মুখোমুখি হই। তারা এসে বলে ভাই তোমার কাছে যা আছে দিয়ে দাও। আমার কাছে ব্যাগ আর কাগজপত্র ছিল। আমি কি জন্য বেরিয়েছি সব খুলে বলি। কিন্তু তখন তারা বিশ্বাস করছিল না। বললো যদি তুমি সব কিছু না দাও তাহলে তোমাকে গুলি করে মেরে ফেলবো। আমি জীবনে প্রথমবার বন্দুক দেখি। কি বলবো, কি করবো আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। আমি ভেবেছি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি। আমি মনে করি প্রত্যেক মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করলে সে বোঝার জন্য প্রস্তুত। এ জন্য আমি বোঝানোর চেষ্টা করেছি আমার সম্পর্কে, আমার যাত্রা সম্পর্কে। বলার পর একজন আমাকে দাড় করিয়ে বললো ভাই আপনাকে আমি নিরাপদ জায়গাতে ছেড়ে দেব। আর খাবারও খাওয়াবো, কিছু টাকাও দেব।
এমনও মানুষ থাকে যাকে আপনি যদি বোঝানোর চেষ্টা করেন তাহলে সে সাহায্যও করবে। যে চুরি, ডাকাতি এমনকি মারতেও এসেছিল, সেই সহযোগিতা করল এর চেয়ে মনুষত্ব কী হতে পারে।
এই যাত্রায় অর্থায়নের উৎসের বিষয়ে রোহান বলেন, যখন আমি যাত্রা শুরু করি তখন আমার বেশি টাকা-পয়সা ছিল না। আমি মনে করি পয়সা এই যাত্রায় প্রতিবন্ধকতা নয়। এই যে কাজ এটা তো সমাজের জন্য। আর সমাজ আমাকে সহায়তা করে যাত্রায়। বিভিন্ন ধরনের মানুষ সহায়তা করে। এমন নয় যে একজন ব্যক্তিই আমাকে সহযোগিতা করছে, সবাই করে। এনজিও, কোম্পানিও সহযোগিতা করে। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে দেখা হলে তাদের আমি বলি, তাদের ভালো লাগলে সহযোগিতা করে। খুলনায় সোমবার এসেছি। এখানে মেয়র, যুবলীগ নেতা, এনজিওর সঙ্গে দেখা করেছি। পরিবেশ বিষয়ে আমার বার্তা পৌঁছে দিয়েছি। আরও অনেকের সঙ্গে দেখা করব।
রোহান বলেন, আমি অনলাইনে লেখাপড়া করি। ব্যাচেলর অব কমার্স নিয়ে পড়ছি। অনলাইনে ক্লাস করি, তাই সশরীরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। আমার বাবা ও মা আর ছোট এক বোন রয়েছে। বাবার ছোট একটি দোকান রয়েছে।
রোহান আগারওয়াল দেখা করেছেন খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের সঙ্গে। এ সময় রোহানের পরিবেশ নিয়ে যে পদযাত্রা সেটাকে স্বাগত জানিয়েছেন সিটি মেয়র।
রোহানের পদযাত্রায় সহযোগিতায় এগিয়ে আসা খুলনার মধুস‚দন মন্ডল বলেন, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য হেঁটে নেপাল ভ্রমণ শেষে বাংলাদেশে এসেছেন রোহান। দেশের ৪৫টা জেলা ভ্রমণ করে পদযাত্রা করে ৪৬তম জেলা হিসেবে খুলনায় এসেছেন। খুলনা নগরের বিভিন্ন স্থাপনা তিনি হেঁটে দেখেছেন। তার উদ্দেশ্য হল প্লাস্টিকের বজ্য বর্জন ও পরিবেশের জন্য হুমকি স্বরুপ যেসব কাজ আছে সেগুলো সম্পর্কে সচেতন করা।
খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, রোহান নিজ দেশসহ বহুদেশ ঘুরেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছে। খুলনায় এসেছে। তার এই বয়সে পরিবেশ নিয়ে যে উদ্যোগ, এটার আমি প্রশংসা করি। সবাই এটা করেও না এবং করতে চাইও না। আমি মনে করি তার একটা সফলতা অবশ্যই আসবে। আজকে ছেলেটা পরিবেশ রক্ষায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এই কারণে মানুষ উদ্বুদ্ধ হবে। পরিবেশের ক্ষতিকর দিকগুলো তার এই পদচারণার মাধ্যমে মানুষ জানতে পারবে। আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই।