করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) মোকাবিলার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর বিধিবিধান সম্বলিত একটি রেজুলেশন নিয়ে দর কষাকষি চলছে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামীকাল সোমবার (১১ মে) দর কষাকষি শেষ হবে। এরপর ৪৮ ঘণ্টা কোনও দেশ চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকৃত টেক্সটে আপত্তি না জানালে এটিই চূড়ান্ত বলে ধরে নেওয়া হবে। আগামী ১৮-১৯ মে ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলিতে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হবে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ জড়িত এই রেজুলেশনে। কেননা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য অর্থ সংস্থান কীভাবে হবে তার ওপর এটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলবে। এছাড়া ভবিষ্যৎ মহামারি বা দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি কী হবে তার ওপরও এটির প্রভাব থাকবে। ফলে এই রেজুলেশন থেকে সর্বোচ্চ ফল (ম্যাক্সিমাম বেনিফিট) পাওয়ার জন্য চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও সামনে থেকে দর কষাকষি, আলোচনা ও নিজস্ব মতামত দিচ্ছে।
জেনেভায় কীভাবে দর কষাকষি হয়, এ বিষয়ে অভিজ্ঞ সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মাদ শহীদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'বাংলাদেশ সবসময় আন্তর্জাতিক দর কষাকষিতে ক্ষমতার চেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে (পাঞ্চড এবাভ ইস ওয়েট)।’ এ ধরনের দর কষাকষি অত্যন্ত তীব্র হয় জানিয়ে তিনি বলেন, 'নীতিগত বিষয়ের পাশাপাশি শব্দ, দাড়ি, কমা, সেমিকোলন ইত্যাদির ব্যবহারও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’
কভিড-১৯ সারা পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দিলেও এটি নিয়ে বৈশ্বিক স্তরে নিষ্পত্তিমূলক উদ্যোগ নেই জানিয়ে শহীদুল হক বলেন, 'গত তিন মাসে শুধু নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘে সিঙ্গাপুর ও মেক্সিকোর দুটি রেজুলেশন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে এবং জেনেভায় এই রেজুলেশন নিয়ে দর কষাকষি চলছে।’
এই রেজুলেশনের গুরুত্বের বিষয়ে তিনি বলেন, 'গত কয়েক বছর ধরে বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার ওপর যে অনাস্থা প্রকাশ করা হচ্ছিল, সেটি এর মাধ্যমে কিছুটা হলেও দূর হবে এবং আবারও প্রমাণ হবে—বহুপাক্ষিক ব্যবস্থা বৈশ্বিক মহামারি সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে মূল দায়িত্ব পালন করার বিষয়ে উল্লেখ আছে ওই রেজুলেশনে এবং এর ফলে সমষ্টিগত সমস্যা সমাধানের যে ব্যবস্থা এতদিন বলবৎ ছিল সেটির প্রয়োজনীয়তা আবারও জোরালোভাবে প্রমাণিত হলো বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশের অবস্থান সব ধরনের দর কষাকষি রাজধানীর নজরদারিতে হয়। কিন্তু, এ ধরনের জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের নীতি নির্ধারণের প্রতিফলন যেন বৈশ্বিক স্তরে থাকে সেই বিষয়টির প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা হয় বলে জানান সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব।
রাজধানী থেকে জেনেভায় যারা দর কষাকষি করেন তাদের একটি গাইডলাইন দেওয়া হয় এবং সেটির ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি দেশ তাদের অবস্থান গ্রহণ করে থাকে বলে জানান শহীদুল হক। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে, সেটির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য দিয়েছেন।’
শহীদুল হক বলেন, 'গত ২৩ এপ্রিল ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামে স্বাগত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার ওপর দৃঢ় বিশ্বাস রেখে পৃথিবীর সব দেশের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং যারা ক্ষতিগ্রস্ত ও কম সক্ষম তাদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ার আহ্বান জানান। আর এটিই আমাদের গাইডিং প্রিন্সিপাল।'
গত এপ্রিলে আলোচ্য রেজুলেশনটি প্রস্তাব করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং এরপর বিভিন্ন রাষ্ট্রের মতামতের ভিত্তিতে ধাপে ধাপে এর টেক্সট পরিবর্তিত হয়েছে জানিয়ে শহীদুল হক বলেন, 'সর্বশেষ টেক্সটের যে অবস্থা, সেটি অনুযায়ী, এখানে বাংলাদেশের উদ্বেগের জায়গাগুলোকে আমলে নেওয়া হয়েছে এবং সমাধানের কথা বলা আছে।’
সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব বলেন, 'মহামারি মোকাবিলায় সর্বস্তরের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলো সাম্যতার ভিত্তিতে ওষুধ ও মেডিক্যাল সামগ্রী বন্টনের ক্ষেত্রে যেন অগ্রাধিকার পায় সেটি বলা আছে শেষ রেজুলেশনে।'
এছাড়া এখানে অভিবাসী ও উদ্বাস্তুদের বিশেষ ব্যবস্থার কথাও উল্লেখ আছে জানিয়ে শহীদুল হক বলেন, 'দুটি বিষয়ই আমাদের জন্য জরুরি, কারণ আমাদের এক কোটিরও বেশি মানুষ বিভিন্ন দেশে কাজ করে এবং এখানে ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, 'ইইউ রেজুলেশন নিয়ে আমরা আলোচনার মধ্যে আছি এবং এটি ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলিতে গৃহীত হবে।’
বাংলাদেশের অবস্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, 'আমরা চাই ওষুধ যেন সহজলভ্য হয়, ন্যায্য দাম নিশ্চিত থাকে এবং গোটা বিশ্বের সবাই যেন দায়িত্ব নেয়।’
কো-স্পনসরশিপ
সব ধরনের বৈশ্বিক উদ্যোগে বাংলাদেশ সবসময় অংশগ্রহণ করেছে এবং এ ধরনের বৈশ্বিক উদ্যোগে আরও জোরালোভাবে দৃশ্যমান উপস্থিতি বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মাদ শহীদুল হক।
তিনি বলেন, 'কূটনীতিতে শুধু কথা ও কাজ করলেই হয় না, এটি দৃশ্যমান হতে হবে। এতে করে অন্যরা গুরুত্ব দেয়। এই রেজুলেশনে যেহেতু বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়গুলোর সমাধানের কথা বলা আছে, সে জন্য কো-স্পনসর হলে দেশের গুরুত্ব বাড়ে।’
তহবিল যোগান
উন্নয়নশীল নিম্ন আয়ের দেশ হলেও ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে দ্বিধা করেনি বাংলাদেশ এবং সামর্থ্য অনুযায়ী বৈশ্বিক উদ্যোগে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সবসময় তহবিল যোগান দিয়েছে দেশটি।
শহীদুল হক বলেন, 'এর একটি আলাদা গুরুত্ব আছে। যখন একটি দেশ অর্থ যোগান দেয়, তখন রাজনৈতিকভাবে তার বক্তব্য অনেক বেশি মর্যাদা পায়।’
তহবিল যোগানের ওপর বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বাস্তবায়ন নির্ভর করছে জানিয়ে শহীদুল বলেন, 'আশার আলো হচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ আরও বেশ কিছু দেশ ৮০০ কোটি ডলার দেওয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।’
উন্নয়নশীল দেশগুলো যদি তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে আসে তবে এর গ্রহণযোগ্যতা অনেক বাড়বে জানিয়ে তিনি বলেন, 'সমস্যা-সংকুল পরিস্থিতিতে আমরা সবসময়ে অর্থ সাহায্য দিয়েছি।’