মোমিনুর রহমান, দেবহাটা : দেবহাটার সুশীলগাতীতে সরকারী নীতিমালা লংঘন ও প্রজাস্বত্ত্ব আইন উপেক্ষা করে চার ফসলী জমিতে নির্মান করা হয়েছে মেসার্স কেবি ব্রিকস নামের একটি ইট ভাটা। চার ফসলী জমিতে ইট ভাটা নির্মান বন্ধের জন্য দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, জেলা প্রশাক সহ বিভিন্ন দপ্তরে গণস্বাক্ষরকৃত লিখিত অভিযোগ দিয়েও সাড়া পায়নি দেড় শতাধিক কৃষক। এমনকি নীতিমালা লংঘন এবং জেলা প্রশাসকের সাথে কোন চুক্তি স্বাক্ষর না হওয়া স্বত্ত্বেও মোটা টাকার বিনিময়ে চার ফসলী জমিতে ইটভাটা নির্মানের ছাড়পত্র দিয়েছেন খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের গুটি কয়েক দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের নীতিমালা লংঘন, প্রজাস্বত্ব ও ভুমি ব্যবহার আইন উপেক্ষা এবং জেলা প্রশাসকের সাথে চুক্তি ছাড়াই মোটা টাকার বিনিময়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ম্যানেজ করে দেবহাটা উপজেলার সদর ইউনিয়নের সুশীলগাতী গ্রামের প্রায় ২০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে গত বছর কেবি ব্রিকস নামের ইটভাটা নির্মানের কাজ শুরু করেন ঢাকা গুলশানের ক-৬১/৮ কালাচাদপুর এলাকার কথিত রবিউল ইসলাম নামের এক প্রভাবশালী। সরকারী নীতিমালার তোয়াক্কা না করে এবং পরিবেশের ভারসম্যকে ধ্বংসের মুখে ফেলে সম্পুর্ন নিয়ম বহির্ভূত ভাবে জনবসতি এলাকার পাশেই চার ফসলি জমিতে ইট ভাটা নির্মান কাজ শুরুর পরপরই তা বন্ধের জন্য দেবহাটা উপজেলা ও সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের কাছে দেড় শতাধিক কৃষক গণস্বাক্ষরকৃত লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগ দায়েরকালে ফসলী জমিতে ইট ভাটা নির্মান বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে কৃষকদের মৌখিক আশ্বাস দিয়ে পরে অজ্ঞাত কারনে বিষয়টি চেপে যান তৎকালীন দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাফিজ-আল-আসাদ। ফলে দেড় শতাধিক কৃষকের দাবী আর আলোর মুখ দেখেনি। অন্যদিকে মোটা টাকার বিনিময়ে এরই মধ্যে খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র নিয়ে নেয় নির্মানাধীন ইট ভাটাটির মালিক সুচতুর রবিউল ইসলাম। যার ছাড়পত্র নং- ১৮-০৬৭৮৭। আর সেই সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে বছর জুড়ে তড়িঘড়ি নির্মান কাজ চালিয়ে ওই চার ফসলী জমিতেই ইট ভাটাটির পুরোপুরি নির্মান কাজ শেষ করে ফেলে কতৃপক্ষ। এদিকে নির্মান কাজ চলমান অবস্থাতেই ইট দেয়ার দাদনের নাম করে ভাটা মালিক রবিউল এলাকার বহু নীরিহ মানুষের কাছ থেকে ১৫-২০ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে এলাকাবাসী। শুধু তাই নয়, সরকারী চাকুরি পাইয়ে দেয়ার নাম করে একাধিক ব্যাক্তির থেকে আরো প্রায় ২০ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে ভাটার মালিক রবিউলের বিরুদ্ধে। নির্মানাধীন ইট ভাটার চারপাশে জুড়ে মাত্র কয়েক গজ দুরত্বের মধ্যেই রয়েছে বিস্তৃর্ন ধানের ক্ষেত ও শীতকালীন সবজি সহ অন্যান্য ফসলের সমারোহ। এছাড়া ইটভাটার পুর্ব ও দক্ষিন দিকে জনবহুল দেবহাটা সদর, পশ্চিমে সুশীলগাতী ও উত্তর পাশে রয়েছে টাউনশ্রীপুর সহ কয়েকটি গ্রামের বিস্তৃর্ন জনবসতি। এসব এলাকায় জনবসতির পাশাপাশি রয়েছে একাধিক স্কুল-কলেজ, মাদ্রসা, মসজিদ সহ বহু ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আবাসিক এলাকার পাশেই ইট ভাটা স্থাপন করায় কয়েকশ পরিবার হুমকির মুখে পড়বে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তাছাড়া ভাটা এলাকার পাশ্ববর্তী বিপুল পরিমান চার ফসলী জমির ফসলহানী ঘটার আশংকাও করছেন স্থানীয়রা। এছাড়া ১৯৫১ সালের জমিদারী দখল ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯০ নং ধারা অনুযায়ী সরকারের অনুমতি ছাড়া কৃষি জমি অকৃষি কাজে ব্যবহার বা ব্যবহারের জন্য হস্তান্তর সম্পূর্ণ বে-আইনী হলেও ইট ভাটাটি নির্মানে জমি হস্তান্তর করা হয়েছে। এই আইন অমান্য করে জমি হস্তান্তর বা ব্যবহার করলে সে জমি বাজেয়াপ্ত করা যেতে পারে। এই আইনের ৭৬ নং ধারা মতে কোন জমি কৃষক ছাড়া অন্য কারও কাছে হস্তান্তর কিংবা বন্দোবস্ত দেওয়া সম্পূর্ণ অবৈধ। এ সকল আইনও মানেননি প্রস্তাবিত ভাটা এলাকার জমি ইজারাদাতা ও ভাটা কতৃপক্ষ। এদিকে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভূমি মন্ত্রালয়ের জারি করা ইটখোলা নির্মানের জন্য ভূমি ব্যবহার প্রসঙ্গ শীর্ষক সার্কুলারে (স্মারক নং ভূ:ম:/ শ-১০/শু:দ:/ সাধারণ/১৭/১০/৫৭২(৬৪) তারিখ ২৫-৭-১৯৯০ইং) বলা আছে, অনুর্বর কৃষি জমির ওপর ইটের ভাটা তৈরীর প্রস্তাব জেলা প্রশাসকের কাছে দাখিল করতে হবে। জেলা প্রশাসক তদন্ত সাপেক্ষ কেবলমাত্র অনুর্বর অকৃষি জমিতেই ইটের ভাটা স্থাপনের অনুমোদন দেবেন। ভাটা তৈরীর আগে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা ও জেলা প্রশাসকের মধ্যে এ বিষয় চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। চুক্তি পত্রে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি শর্ত লিখিত থাকতে হবে। যেমন একটি ইটের ভাটার জন্য দেড় একরের বেশি জমি ব্যবহার করা যাবে না। ইট তৈরীর জন্য একই স্থান থেকে মাটি কাটতে হবে। মাটি কাটার স্থানকে পাড় বিশিষ্ট পুকুরে পরিণত করতে হবে, যেন মাছের চাষ করা যায়। এই শর্ত ভঙ্গ কারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। কিন্তু ভাটার মালিক রবিউল ইসলাম এমন কোন চুক্তি ছাড়াই ভাটাটি স্থাপন করেছেন। স্থানীয়রা জানান, সুশীলগাতীর জনবসতিপুর্ন ওই চার ফসলী জামিতে ইট ভাটাটি নির্মিত হলে এই এলাকায় থাকবে না তেমন কোন গাছের ফল। পুড়বে গাছের পাতা। ভাটার ছাইতে ভরে যাবে ঘর-বাড়ি, রান্নাঘর। জামা-কাপড় মেলা যাবে না শুকানোর জন্য। শুকিয়ে যাবে আশেপাশের ফসলি জমির রস। পুড়ে যাবে ইরি, বোরো ও আমন ধানের ক্ষেত। কয়েক শত বিঘা জমির ধান, পাট, সরিষা, গম, মশুর, শিম, আলু, বেগুন, পেয়াজ, রসুন সহ বিভিন্ন মৌসুমের ফসল ও সবজির উৎপাদন একবারে কমে যাবে। এতে করে চাষীদের পাশাপাশি তীব্র ক্ষতির শঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন এলাকাবাসীরাও। তাই অবিলম্বে এই ইট ভাটা স্থাপনের কাজ সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ করার জন্যও দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কাছে দাবী জানিয়েছেন স্থানীয়রা। অন্যথায় তীব্র ক্ষতির ঝুকিতে থাকা কৃষক ও এলাকাবাসীরা নিজেদের ফষল ও পরিবেশ বাঁচাতে বাধ্য হয়ে প্রশাসন, ইট ভাটার মালিক ও জমিদাতাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে বাধ্য হবেন বলেও প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল বলেন, সাতক্ষীরাতে পরিবেশের ক্ষতি করে এবং অবৈধ কোন ইট ভাটা নির্মান করতে দেয়া হবেনা। এধরনের ইট ভাটা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হবে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।