
আতিয়ার রহমান, মণিরামপুর: কলেজ ছাত্র বোরহান কবির (১৮) হত্যার রেশ না কাটতেই মামুনুর রশিদ (২০) নামের এক মাদ্রাসার ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত দুই মাসে দুইজন শিক্ষার্থীসহ পৃথক ৪টি হত্যা কান্ডের ঘটনায় যশোরের মণিরামপুরবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। তবে, এসব ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সাধারন মানুষের মাঝে।
চোর সন্দেহে ৬ ফেব্রুয়ারী সকালে মণিরামপুরের খালিয়া গ্রামের রাস্তার মোড়ে কলেজ ছাত্র বোরহান কবিরকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। খবর পেয়ে রাজগঞ্জ পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের উপ-পরিদর্শক তপন কুমার নন্দিসহ দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা আহত বোরহান কবিরকে হাতকড়া পরিয়ে তদন্ত কেন্দ্রে নেয়। পরিবারের লোকজন আহত বোরহানকে চিকিৎসার জন্য উদ্ধারের চেষ্টা করলেও পুলিশ তার পরিবারের হাতে তুলে দেন আড়াই ঘন্টা পর। ততক্ষনের মধ্যে শরীরের রক্ত ঝরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় সে। দুপুরে হাসপাতালে আনার পর পরদিন সকালেই তার মৃত্যু হয়।
উপজেলার মোহনপুর গ্রামের আহসানুল কবিরের ছেলে এই বোরহান কবির মনিরামপুর সরকারী ডিগ্রী কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলো সে। মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ায় পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর এক পর্যায়ে ৬ ফেব্রুয়ারী কৃষ্ণবাটি গ্রারে নাঈম ও নাজমুলসহ একদল যুবক চোর সন্দেহে তাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে। ঘটনার প্রতিবাদে থানা ঘেরাও’সহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালনের মধ্যে দিয়ে উত্তাল হয়ে উঠে মনিরামপুর। পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রনে আনতে উপ-পরিদর্শক তপন নন্দীসহ ওই দুই পুলিশ সদস্যকে তদন্ত কেন্দ্র থেকে প্রত্যহার করা হয়।
এদিকে গত মঙ্গলবার (১৬ ফেব্রুয়ারী) রাতে উপজেলার খোজালিপুর গ্রামে মামুনুর রশিদ (২০) নামের এক মাদ্রাসা ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করেছে দূর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় পিতা মশিয়ার রহমান ১২জনকে অভিযুক্ত করে বুধবার মনিরামপুর থানায় মামলা দায়ের করে। পুলিশ এ ঘটনায় মিন্টু, সোহাগসহ তিনজনকে আটক করেছে। পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছে, ঘটনার রাতে মামুনুর রশিদ খোজালিপুর তার নিজ গ্রামে মাঝের পাড়ায় রাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে আসছিলো। এ সময় এলাকার কতিপয় যুবক তাকে চোর আখ্যা দিয়ে বেধড়ক মারপিট করে। বুধবার সকালে মা সখিনা বেগম আহত ছেলে মামুনকে হাসপাতালে ভর্তি করলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুপুরেই তার মৃত্যু হয়। নিহত মামুন মনিরামপুর ফাযিল সিনিয়র মাদ্রাসায় আলিম দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলো। ১০ দিনের ব্যবধানে দু’জন শিক্ষার্থীকে চোর অপবাদে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় সাধারন মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। অনেকে অভিভাবকের দাবী পরিস্থিতি যে পর্যায়ে পৌছেছে তা ঘরে ছেলে বাইরে গেলে সুস্থ্য জীবনে ঘরে ফিরবেন এমন নিশ্চয়তা থাকছে না।
গত ৭ জানুয়ারী উপজেলার খালিয়া গ্রামের চা দোকানী জালাল উদ্দিন (৫৫) ফজরের নামাজ আদায় করতে মসজিদের দিকে গেলে জীবিত আর ঘরে ফেরেনি। এ দিন সকালে পরিবারের লোকজন তাকে খুঁজে পায় গ্রামের মাঠের বোরো ধান ক্ষেতে। স্ত্রী শাহিদা খাতুন বাদি হয়ে মামলা দায়ের করলেও পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রাজগঞ্জ পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ শাহাজান আহমেদ জানান, মামলার তদন্ত কার্যক্রম চলছে। তবে ঘটনার কোন কুলকিনারা পাওয়া যায়নি। জালাল উদ্দিন এ গ্রামের মৃত. আজিবর রহমানের ছেলে। সাদাসিধে জীবন যাপন করা এই জালাল উদ্দিন সংসার চালাতে খালিয়া মাদ্রাসা মোড়ে একটি চায়ের দোকান চালাতো বলে জানান এ গ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা মিকাইল হোসেন। তবে এ মামলার তদন্তের অগ্রগতি না হওয়ায় মামলার বাদি শাহিদা খাতুন অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
গত ২৯ জানুয়ারী রাতে দূর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে মুকুল হোসেন নামের এক যুবককে। উপজেলার শিরালিমদনপুর গ্রামের আমিন মোড়লের ছেলে মুকুল। মাদক ও অস্ত্র আইনে একাধিক মামলার আসামী মুকুলকে ঘটনার রাত ১০টার দিকে তার নিজ গ্রামের কবরস্থানের পাশে রাস্তায় দূর্বৃত্তরা কুপিয়ে জখম করে। পরিবারের লোকজন রাতে যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা তার মৃত্যু ঘোষণা করে। এ ঘটনায় পিতা আমিন মোড়ল বাদি হয়ে মনিরামপুর থানায় মামলা দায়ের করে। পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত তিনজনকে আটক করতে সক্ষম হয়েছে।
দু’জন শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যার বিষয়ে জানতে চাইলে মনিরামপুর সরকারি ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ রবিউল ইসলাম ফারুকী এবং মনিরামপুর ফাযিল সিনিয়র মাদ্রাসার অধ্যক্ষ শহিদুল ইসলাম উদ্ব্যেগ প্রকাশ করে বলেন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের চোর বলে পিটিয়ে হত্যা করার বিষয় কোন সভ্য সমাজ মানতে চাইবে না। তারা পৃথক এ দু’টি হত্যা কান্ডের দ্রুত বিচারের দাবী করে বলেন, আর যেন এমন দুঃসংবাদ না শুনতে হয়।
মণিরামপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রফিকুল ইসলাম জানান, পৃথক এ চারটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে পুলিশ তৎপর রয়েছে। খুব শিঘ্রুই অপরাধীদের আটকের চেষ্টা চলছে।