বাসায় অফিস খুলে জাল-জালিয়াতির সব কাগজ তৈরী;
সবকিছু ঘটেছে সভাপতির অগোচরে;
অধ্যক্ষ’র দুর্নীতি রুখবে কে?
বিশেষ প্রতিবেদক:
একটি প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহের জন্য আবেদন। দিবা-নৈশ কলেজের দোতলায় অফিস কক্ষ। সেখানে তিন জন মহিলা (সম্ভবত আয়া), তিন জন পিওন ও তিনজন অফিস সহকারী। নিজেদের মধ্যে আলোচনা- বিষয়বস্তু কলেজ সংস্কারের নামে ভাঙা গড়া ও অনিয়ম-দুর্নীতি। বিক্ষিপ্ত আলোচনা শুনে নিজ কাজ বাদ দিয়ে বিক্ষিপ্ত পায়চারি। সবার মুখে একই কথা অধ্যক্ষের লুটপাটের কাহিনী।
এ পর্যন্ত ঘটনার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। মার্চের শেষ হতে মিশন শুরু। নানা বাহানায় কলেজে পদার্পন। একের পর এক উৎঘটিত হতে থাকে নানা তথ্য। অফিস হতে হাতে আসে কিছু দলিল -দস্তাবেজ। তারপরেই এই প্রতিবেদন। যা ইতোপূর্বের দুইটিতে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
সর্বশেষ নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি উৎঘাটনে সময় লাগলো বেশ কিছু দিন। সম্পূর্ণ সত্যতা যাচাইয়ের জন্য এই প্রতিবেদনে কথা বলতে হয়েছে শিক্ষক-কর্মচারী, উপাধ্যক্ষ্য, বিভাগীয় প্রধান, নতুন নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষক, শিক্ষক প্রতিনিধি (জিবির সদস্য) স্টাফ কাউন্সিলের সেক্রেটারী, গর্ভর্নিং বডির সদস্যদের সাথে।
নিয়োগ না বিনিয়োগ?
অফিস হতে ডকুমেন্টস ও বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জানা যায়, সাতক্ষীরা দিবা-নৈশ কলেজে ২০১৩-১৪ শিক্ষা বর্ষে প্রথম ৫টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হয়। সে মোতাবেক ২০১২ সালের ৫ অক্টোবর শুক্রবার প্রথাম দিনে ৩টি বিষয়ে নিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে (লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা) (৫+৫+৫)=১৫জন অনার্সের শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে আরো ৩টি এবং পরে পর্যায়ক্রমে আরো কয়েকটি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু করা হয়। সর্বশেষ ১২টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু করা হয়। যা ২০১৭ সালের পূর্বেই সম্পন্ন হয়। যে কারনে সকল অনার্স শিক্ষক ২০১২ সালের অক্টোবর হতে ২০১৬ সালের শেষাংশ বা ২০১৭ সালের প্রথমাংশে নিয়োগ প্রদান সম্পন্ন হয়।
এরই মধ্যে ২৮ ফেব্রæয়ারি ২০১৮ তারিখ শিক্ষা মন্ত্রনালয় একটি পরিপত্র জারী করে। ৪ ফেব্রæয়ারি ২০১০ সালের পূর্বে ডিগ্রী স্তরের ৩য় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েও যারা শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু এমপিও ভুক্তি হননি তাদের নামের তালিকা পাঠাতে বলা হয় উক্ত পরিপত্রে। ১২ই মার্চ ২০১৯ তারিখে একই পরিপত্র জারির মাধ্যমে শর্তারোপ করে বলা হয় উক্ত তালিকায় শুধুমাত্র ডিগ্রী স্তরের জন্য নিয়োগ দেয়া ছিল যা ২০১০ সালে ৪ ফেব্রæয়ারির আগে তাদের নাম থাকবে। কোন মতেই অনার্স বা মাস্টার্সের নিয়োগ পাওয়া কোন শিক্ষকের নাম থাকবেনা। এর ব্যত্যয় ঘটবে কলেজ প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উক্ত ২৮ অগাস্ট ২০১৮ ও ১২ মার্চ ২০১৯ তারিখের পরিপত্রকে সামনে রেখে দিবা-নৈশ কলেজে চলতে থাকে তুঘলকি কান্ড। পরিপত্র জারির সময়ে এই কলেজে একজন মাত্র বৈধ শিক্ষক ছিলেন, যিনি ডিগ্রী স্তরে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রæয়ারির আগে নিয়োগ প্রাপ্ত। তিনি ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক আবু তারিখ। তার নিয়োগের তারিখ ২৪ ডিসেম্বর ২০০২। অথচ সাতক্ষীরা দিবা-নৈশ কলেজে ১৩ জন শিক্ষক যারা সবাই ২০১২ সালের পর হতে অনার্সের নিয়োগ প্রাপ্ত। কিন্তু বিপুল অর্থের বিনিময়ে সার্কুলার, নিয়োগ বোর্ড, হাজিরা পত্র, রেজুলেশন সহ নিয়োগ প্রক্রিয়ার সকল কর্মকান্ড, সই-স্বাক্ষর সকল কিছু জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তাদের এমপিও ভুক্ত করা হয়। এর জন্য অনেকের নিবন্ধন সার্টিফিকেট স্ক্যান করা সহ নানা জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়।
এ বিষয়ে গভর্ণিংবডির কেহই জানতেন না। এমনকি সভাপতি মহোদয়ের কাছেও অবহিত করা হয়েছে বলে মনে হয় না।
নতুন এমপিও ভুক্ত একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রিন্সিপ্যাল এক এক করে তার নিজস্ব বাসভবনে ডাকেন। বিল্ডিং এর ৩য় তলার উত্তর পশ্চিম ধারের কক্ষে বসেন। যেখানে কারো ঢোকার অধিকার নেই। এমনকি নিজ পরিবারের কারোর নয়। এটা তার আরেকটি অফিস। এখানে পৃথক রেজুলেশন খাতা সহ সব কিছু আছে। এখানে বসে ডোনেশনের হিসাব, রেজুলেশন তৈরি, সই-স্বাক্ষর, সব কিছু নগদ না দিতে পারলে তিনি নিজ থেকেই রুপালী ব্যাংকে একাউন্ট খুলে লোনের ব্যবস্থা করে দেন।
নিয়োগ সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয় জানতে সরাসরি যোগাযোগ করি সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধানদের সাথে। সকল বিভাগীয় প্রধানগন নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন।
ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রধান ফেরদৌসী বেগম, গোলাম মোস্তফা সাহেবের নিয়োগের ব্যপারে জানান, তিনি অনার্সের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। তার এমপিও ভুক্তির ব্যাপারে কিছুই জানেন না। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান জানান ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে প্রথম রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হয়। সে সময়েই জনাব ফারুক হোসেন ও শাহিনা আক্তারের নিয়োগ দেয়া হয় অনার্সের শিক্ষক হিসেবে। অর্থাৎ তাদের নিয়োগ ২০১২/১৩ সালের দিকে।
ভ‚গোল বিভাগের প্রধান মোশতাক আহমেদ, যিনি জেলার স্বনামধন্য কবি ও লেখক এবং কলেজে যার গ্রাহনযোগ্যতা বেশি। তিনি তার বিভাগের পরোজিত কুমার সম্পর্কে বলেন, পরোজিতের এমপিও ভুক্তির ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। কিন্তু তার নিয়োগ অনার্সের শিক্ষক হিসেবেই।
সমাজবিজ্ঞাপন বিভাগের প্রধান লুৎফর রহমান বলেন, ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে অনার্সের নিয়োগ দেয়া শুরু হয়। সে মোতাবেক তার বিভাগে মোট ৫ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। যার মধ্যে প্রভাতী রানা মন্ডল ছিলেন। পরবর্তীতে হঠাৎ এমপিও ভুক্ত হলে তবেই জানতে পারেন প্রভাতী রানী এমপিও ভুক্ত হয়েছেন। কিভাবে তা জানেন না।
ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান জনাব স›িদ্বপ কুমার বসু, যিনি একাধারে শিক্ষক প্রতিনিধি অর্থাৎ গভর্নিংবডির সদস্য। তিনি জানান তার বিভাগের কানিজ অনার্সের শিক্ষক হিসেবেই নিয়োগপ্রাপ্ত। তিনি আরো জানান এই ১৩/১৪ জনের এমপিও ভুক্তি সম্পর্কে গভর্নিংবডির সদস্য হিসেবে তিনি নিজে কিছু জানেননা বা কোন রেজুলেশনে সই করেছি বরে মনে পড়ে না।
হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রধান জনাব মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিস্তারিত সাল-তারিখ দিয়ে বলতে পারবনা তবে মহিবুল্লাহ সাহেবের নিয়োগ পান অনার্সের শিক্ষক হিসেবে। এবং নিয়োগও ঐ সময়েই হয়েছিল।
মার্কেটিং বিভাগের প্রধান জনাব দেব কুমার ঘোষ বলেন, তার বিভাগের শাহজাহান আনছারী অনার্সের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত। আমরা ঐ সময়েই অনার্স কোর্স চালু করি এবং ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ভর্তি করি। সে সময়েই তার নিয়োগ দেয়া হয়।
বাংলা বিভাগের প্রধান আব্দুল্লাহ, মহিনুর রহমানের নিয়োগের ব্যাপারে বলেন বাংলা বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হওয়ার সময় অনার্সের শিক্ষক হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়।
ইংরেজি বিষয়ের প্রদ্যুৎ কুমার বলেন, আমি এসব বলতে পারবনা। জানা নেই। আমি আমার বেতন কত তাই জানিনা। ক্লাস নেই সবাইকে নিয়ে এটুকুই।
সমাজকর্ম বিভাগের প্রধান রফিউদ্দীন বলেন, অনার্স কোর্স চালূর সময় চম্পা বিশ্বাসের নিয়োগ হয় নি। তার আগমন ঘটেছে পরে। তবে নিয়োগের ব্যাপারে ও এমপিও ভুক্তির ব্যাপারে কিছুই জানিনা।
বিভাগীয় প্রধানগনের বক্তব্যে এটাই স্পষ্ট যে, যেকজন শিক্ষক এমপিও ভুক্ত হয়েছেন, তাদের কেহই ২০১২/১৩ সালের আগে নিয়োগ পাননি। এমনকি কেহই ডিগ্রী পর্যায়ের নিয়োগ প্রাপ্ত নন। আবার তারা সবাই অনার্সের নিয়োগ প্রাপ্ত। ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপনকে সামনে রেখেএদের নিয়োগ যুক্তিযুক্ত নয়।
এ ব্যাপারে শিক্ষক প্রতিনিধি যারা গভর্নিং বডির সদস্য তাদের সাথে কথা বললে জনাব বেলাল গাজী ও কামরুন্নাহার বলেন, এসব অনার্স বিষয়ের শিক্ষকদের এমপিও ভুক্তির ব্যাপারে গভর্নিংবডির কোন সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে মনে হয় না। বা কোন রেজুলেশনে সই স্বাক্ষর করেছি বলে মনেই হয় না।
উপরোক্ত বিষয়ে আরো তথ্য সংগ্রহে অফিসের লোকজন ও সাধারণ শিক্ষকবৃন্দ আশ্চার্য হয়ে বলেন, এ দেশে কত কিছুই হয়। আর আমাদের কলেজে এসব কোন ব্যাপারই না। নিয়োগ-বেতন করা এ কলেজে খুব সহজ। একজন শিক্ষককে কলেজ গেটে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন এসব আমাদের সাথে না বলে গভর্নিং বডির সাথে বলেন, তারা প্রকৃত সত্য জানতে পারবেন।
একজন পিওন এসময় বলেন, শুধু শিক্ষক নয় পাশে ঝুল বারান্দায় তালাবদ্ধ কক্ষ দেখিয়ে বলেন, এখানেও কয়েকজন নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী আছে। যাদের কোন পদ নেই। আমরা কলেজ থেকে কোন টাকা পয়সা পাই না। আর এর ভিতরে কয়েকজনকে ধরে এনে বসিয়ে কলেজ থেকে প্রতিমাসে ১৫/২০ হাজার টাকা ওদের দেয়া হচ্ছে। ওদের নিয়োগ প্রিন্সিপ্যাল নিজেই দিয়েছেন। ওদের জন্য টাকা নেন অফিস থেকে কিন্তু যায় কোথায় কে জানে? তিনি বলেন এটাও একটু লিখে দিয়েন।
বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত ও বিভাগীয় প্রধানসহ অনান্যদের বক্তব্যে স্পষ্ট যে, ১৩ জন অনার্স শিক্ষকদের এমপিও ভুক্ত করা হয়েছে তা সম্পূর্ন অবৈধ উপায়ে। গভর্নিং বডির আগোচরে, এমনকি সভাপতির ও অগোচরে। এর জন্য লেনদেন হয়েছে কোটি টাকার মত।
প্রশ্ন হলো এসব অনার্সের শিক্ষকের নিয়োগ ২০১২ সালের পর হয়ে থাকলে ডিগ্রি পর্যায়ে নিয়োগ দেখাতে অবশ্যই কাগজপত্র সব তৈরি করতে হয়েছে। বিজ্ঞাপণ প্রদান, বোর্ড গঠন, এক্সপার্ট আনা, পরীক্ষা নেয়া ও রেজাল্ট শীট তৈরি, গভর্ণিং বডির প্রতিটি সিদ্ধান্তের রেজুলেশন, সভাপতি মহোদয়ের স্বাক্ষর সম্বলিত ফরওয়ার্ডিং সবকিছু কি করে সম্ভব। গভর্নিং বডি কি এসব প্রসেস পালন করেছেন? ৩/৪ ধাপে এসব শিক্ষকদের এমপিও ভুক্তি করা হয়। তাহলে অন্ততঃ ৫/৬ বার মিটিং, রেজুলেশন করার কথা। গভর্নিং বডি কি এসব করেছেন? যদি করে থাকেন তবে কতটুকু আইনানুগ হলো। আর যদি না করে থাকেন তবে কাজটি হলো কিভাবে? গভর্নিং বডি কি তবে অসহায় নাকি গুরুত্ব দেন না/নাকি ওনারা জেগে জেগে ঘুমান।
সমগ্র বিষয়টি নিশ্চিতভাবে অরাজকতার বহিঃপ্রকাশ। এতবড় একটি কলেজের গভর্নিং বডির ক্ষমতা অনেক। অধিকাংশ শিক্ষক কর্মচারি মনে করেন, বর্তমান গভর্নিং বডি যথেষ্ট ডায়নামিক। সদর এমপি স্বয়ং এই কলেজের সভাপতি। তার প্রতি সবার আশা,বিশ্বাস অনেক। তিনি থাকতে বা অন্যসব সদস্য থাকতে এমন তুঘলকি কান্ড ঘটে যাওয়া কলেজটাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। সমস্ত শিক্ষক কর্মচারি আজ দারুন অসহায়। বেপরোয়া অধ্যক্ষের বেপরোয়া কাজে সবাই অতিষ্ট। সারাক্ষণ তার সমালোচনায় মুখর। যেটা কলেজে অবস্থান করলে বুঝা যায়। তবে দু’একজন শিক্ষক এর ব্যতিক্রম বলে একজন পিওন বলেন, দু’একজন যাদের গুষ্টিসমেত চাকরি করে এখানে। যার নিকট আত্মীয়ের নিবন্ধনও জাল তাই এরকম দু’একজন থাকবেই।
তুদপরি ২/১ জন বাদে সব ষ্টাফই আজ নিদারুন যন্ত্রনায় ভুগছে। সাক্ষাতদানকারীর প্রত্যেকের অনেক কথা বক্তব্যে দেয়া হয়নি। বাকিটা পাঠকের অনুধাবনের বিষয়। সর্বপরি কলেজ বাচাতে গভর্নিং বডির কার্যকর পদক্ষেপ জরুরী। না হলে করোনা পরবর্তীকালে পরিবেশ হতে পারে ঘোলাটে।