জাতীয় ডেস্ক:
মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা রাশিয়ার জাহাজ বাংলাদেশে ভিড়তে না দেওয়ায় সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মস্কো।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে ক্রেমলিনের এমন উষ্মা স্বাভাবিক কূটনৈতিক রীতি হলেও অনেকেই বিষয়টাকে ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছেন। শক্তিশালী দেশগুলোর ভূরাজনৈতিক এবং কৌশলগত প্রতিযোগিতার কারণে বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়ছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতি জোর দিচ্ছেন।
বিষয়টি সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলি সাবরিন বৃহস্পতিবার নিয়মিত ব্রিফিংকালে সাংবাদিকদের বলেছেন, নিষেধাজ্ঞাভুক্ত রাশিয়ার সাত কোম্পানির ৬৯টি মাদার ভেসেলকে বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তে না দেওয়ার সরকারি নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী রুডেনকো আন্দ্রে ইউরেভিচ ২১ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানান।
এ সময় রাশিয়ার উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা বিবেচনায় রাখার অনুরোধ জানান।
এছাড়া তিনি এ ঘটনায় রাশিয়ার উদ্বেগের বিষয়টি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ করেন। আলোচনাকালে রাষ্ট্রদূত করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন বিরোধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার কথা তুলে ধরেন। পাশাপাশি তিনি রাশিয়ার ৬৯টি মাদার ভেসেলকে বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তে না দেওয়ার সরকারি নির্দেশনার প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থানও তুলে ধরেন।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা রাশিয়ার জাহাজটি রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম নিয়ে আসছিল। বঙ্গোপসাগরে বহির্নোঙরে থাকাকালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সতর্ক করে, জাহাজটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত। বাংলাদেশ জাহাজটিকে তীরে ভেড়ার অনুমতি দেয়নি। এ ঘটনার পরপরই বাংলাদেশে রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকসান্দ্রার মান্তিৎস্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে জাহাজটিকে ভিড়তে দেওয়ার অনুমতির জন্য দেনদরবার করেন। কিন্তু বাংলাদেশ কিছুতেই রাজি হয়নি।
ঘটনার এক মাস পর মঙ্গলবার মস্কোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে জাহাজ ভিড়তে না দেওয়ার প্রতিবাদ জানানো হয়। সূত্র মতে, রুশ কর্মকর্তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে জানান, জাহাজটির ওপর জাতিসংঘের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। ফলে একক কোনো দেশের নিষেধাজ্ঞা পালনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
ঢাকার কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করা কঠিন। কারণ বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুবিধ সহযোগিতা রয়েছে। এছাড়া এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের পক্ষে মোকাবিলা করা কঠিন। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির একক প্রধান বাজার।
সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি পোশাক কোম্পানির বিরুদ্ধে কপিরাইট আইন লংঘনের অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি নিয়ে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তর উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশের কাছে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে।
এছাড়া জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র বেশি পরিমাণে অর্থ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের অন্যতম প্রধান শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। বাংলাদেশে গণতন্ত্র, নির্বাচন, মানবাধিকার প্রভৃতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ জানিয়ে থাকে। এমন এক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় থাকা কোনো জাহাজকে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে নিষেধাজ্ঞায় থাকা রুশ জাহাজকে নোঙর করতে দেওয়া যে বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয় সেটা রাশিয়াও অনুধাবন করতে পারে। তারপরও ঘটনার এক মাস পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদ জানানোর ক্রেমলিনের সিদ্ধান্তে কিছুটা বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে।
রাশিয়া বলছে, বিষয়টা রুশ সংবাদমাধ্যমে দেরিতে আসায় তারাও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করতে বিলম্ব করেছে। তাছাড়া কেউ কেউ মনে করেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছুটা নরম সুর দেখে রাশিয়ায় উদ্বেগ বেড়েছে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রও এ অঞ্চলে বাংলাদেশকে তাদের বড় মিত্র হিসাবে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এতে মস্কোর মধ্যে এ ধারণার জন্ম হতে পারে, বাংলাদেশ মার্কিন বলয়ে ঢুকে যাচ্ছে। বাংলাদেশকে এখন হয়তো আবারও ব্যাখ্যা করতে হবে, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষার বাংলাদেশের নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।
নিষেধাজ্ঞায় থাকা জাহাজটি ফিরে যাওয়ায় রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল কোথায় গেছে সে সম্পর্কে রোসাটম বাংলাদেশকে কিছুই জানায়নি। তবে ওই জাহাজ ফিরে যাওয়ার পর আরও দুটি রুশ জাহাজ রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম দিয়ে গেছে। পরের দুই জাহাজের ওপর অবশ্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নেই।