রুবেল হোসেন: বর্তমান সময়ে জেলার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল স্বাস্থ্যখাত। বর্তমান সময়ে স্বাস্থ্যসেবা দরিদ্রদের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে অনেক অভূতপূর্ব অর্জন তাকা স্বত্ত্বেও সাতক্ষীরার উপর্কূলীয় যুব ও নারীরা অনেকাংশে পিছিয়ে রয়েছে। দারিদ্রতা, অনুন্নত সেবার মান, বিশেষজ্ঞ জনবলের অভাব হেতু সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর, আশাশুনি সহ জেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত জনপদের মানুষ মারাতœক স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছে।
বর্তমান সরকার গ্রাম পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করলে সেখানকার সেবার মান নিয়ে জনমনে নানান প্রশ্ন। কোথাও ডাক্তার থাকলে ঔষধ নেই আবার কোথাও ঔষধ থাকলেও নেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তার উপর লাফিয়ে বাড়ছে ঔষধ সহ চিকিৎসা সামগ্রীর মূল্য।
এখনো দেশের অধিকাংশ মানুষ ক্যান্সার, হৃদরোগসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের চিকিৎসার জন্য বিদেশের উপর নির্ভরশীল। সেখানে সাতক্ষীরার দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ব্যায়বহুল চিকিৎসা গ্রহণ করতে সক্ষম হচ্ছেন না। ফলে দীর্ঘ্যদিন জটিল রোগে ভোগার পর তারা পতিত হচ্ছেন মৃত্যুমুখে।
সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের সামনে অবস্থিত জার্মান হোমিও চেম্বারে চিকিৎসা নিতে আসা ক্যান্সার আক্রান্ত শ্যামনগরের হাওয়ালভাঙ্গীর গৃহবধু মোমেনা (৬৭) জানান, আমি গত ১ বছর যাবৎ অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য গরু বিক্রি করে ঢাকায় ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার কেমো (কেমোথেরাপী) দিতে বলে। আমার ছেলেরা দিন মজুর তাদের পক্ষে আমার ডাক্তার খরচ টাকা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। লোকমুখে শুনেছি এখানে নাকি ক্যান্সারের ঔষধ দেয় তাই এসেছি।
মোমেনা বেগমের মত জটিল রোগে আক্রান্ত স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত এমন রোগীর ছড়াছড়ি জেলার সর্বত্র।
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতার ও সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে নির্মিত হলেও, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকলেও নানা রকম প্রতিবন্ধকতা এবং প্রতিকূলতার কারণে বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা দিতে ব্যার্থ হচ্ছেন তারা। সদর হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ কাঙ্খিত স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে শতভাগ সক্ষম নয় বলেই বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবার পুরোটাই বেসরকারীখাতে চলে যাচ্ছে। বেসরকারী খাতের স্বাস্থ্যসেবার পুরোটাই সেবা থেকে বেশি বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। সরকারী হাসপাতালদুটিতে প্রাইভেট ক্লিনিকের দালালেরা আগত রোগীদের মোটিভেট করে বিভিন্ন নামী বেনামী ক্লিনিকে উন্নত সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে নিয়ে যচ্ছে। যার ফলে রোগীরা স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির থেকেও বেশি অর্থ খরচের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন। এরকম একটা পরিস্থিতিতে জেলার স্বাস্থ্যসেবা খাত বড় একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে।
জেলার একটি বেসরকারী ক্লিনিকে ভর্তি হন সিজারিয়ান রোগী কুলসুম। সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে আসলে ক্লিনিকের দালাল সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ভাল হয় না। অপারেশনের ডাক্তার নেই। সেখানে রোগীর ভাল ট্রিটমেন্ট করা হয় না ইত্যাদী ভয়ভীতি দেখিয়ে ক্লিনিকে নিয়ে আসেন। সিজারিয়ান অপারেশন ও বেড ভাড়া বাবদ কুলসুমের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। এর উপর খাওয়ার জন্য ঔষধ কিনতে হবে বাইরে থেকে। কুলসুমের স্বামী খলিলের সাথে কথা বলে এমন ভয়ানক তথ্য পাওয়া গেছে। শুধু কুলসুম নয়, প্রতিনিয়ত এমনভাবে সর্বশান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ কুদরত ই খোদা বলেন, “আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। প্রতিনিয়ত ধারণ ক্ষমতার অধিক রোগী আমাদের কাছে আসে ফলে বাড়তি রোগীর চাপ সামলাতে আমরা হিমসিম খাচ্ছি। এছাড়াও রোগীর তুলনায় ডাক্তার ও নার্সদের সংখ্য অপ্রতুল থাকায় স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে ব্যাঘাত ঘটছে। ”
প্রাথমিক সুচিকিৎসা, সন্তান প্রসবসহ নানা রকম প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যখাতে বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবার লাগামহীন বাণিজ্যিক প্রবণতার লাগাম টেনে ধরতে হবে বলে মনে করেন সাতক্ষীরার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি সরকারী হাসপাতালগুলোতে বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে হবে। সাধারণ মানুষ ন্যূনতম মূল্যে সরকারী হাসপাতালে বিশেষায়িত সেবা পায় তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জেলার স্বাস্থ্যখাতটি বর্তমানে পুরোপুরি বাণিজ্যিকীকরণ হয়ে গেছে। যার ফলে টাকা থাকলেই শুধু স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া সম্ভব। টাকা না থাকলে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু অনিবার্য এরকম একটি প্রবণতার মুখোমুখি জেলার মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সেই অবস্থা থেকে একটা জনবান্ধব এবং সবার জন্য সুলভ মূল্যে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করাই হবে বর্তমান সময়ে জেলার স্বাস্থ্যসেবার জন্য চ্যালেঞ্জ।
চ্যালেঞ্জের মুখে জেলার যুব ও নারী বান্ধব স্বাস্থ্যখাত
পূর্ববর্তী পোস্ট