মো: রাকিব, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামে দিন দিন বেড়ে চলেছে কিশোর গ্যাং এর সংখ্যা। কথিত বড় ভাইয়ের ছত্রছায়ায় লালিত হচ্ছে এই কিশোর গ্যাং গুলো। বিশেষ করে যেসব শিশু-কিশোরকে আমরা সুন্দর শৈশব ও কৈশোর দিতে পারিনি, যারা মা-বাবার স্নেহ-ভালোবাসা এমনকি জীবনযাপনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, তারা সহজেই নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। প্রশাসন বিভিন্ন ভাবে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও এদের দৌরাত্ব কমছে না।
শহরের বিভিন্ন স্থানে এদের আড্ডা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। নগরীর স্টেশন রোড, বিআরটিসি মোড়, কদমতলী, চকবাজার, মেডিকেল হোস্টেল, শিল্পকলা একাডেমি, সিআরবি, খুলশি, ফয়েস লেক, ডেবারপার, চান্দগাঁও শমসের পাড়া, ফরিদের পাড়া, আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনি, সিডিএ, ছোটপুল, হালিশহর, বন্দর কলোনি ও পতেঙ্গার বেশ কয়েকটি এলাকায় মাদক বেচাকেনাসহ মোটরসাইকেল ও সাইকেল ছিনতাই, গান-বাজনা, খেলার মাঠ, ডান্স ও ডিজে পার্টি, ক্লাবের আড্ডাসহ বেশ কিছু বিষয় নিয়ন্ত্রণে মরিয়া।
শুধু তাই নয়, এসব কিশোর গ্যাং চক্র মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ ও মোবাইল ছিনতাইয়ের অধিকাংশ ঘটনায় জড়িত। নিজ এলাকা ছাড়িয়ে অনেক সময় তারা নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে নানা অপরাধ কর্মকান্ড চালিয়ে থাকে। এরকম নগরীর ১৬ থানা এলাকায় প্রায় অর্ধশত কিশোর গ্যাং চক্রের তথ্য পুলিশের হাতে এসেছে বলে জানান তিনি।
কিশোর গ্যাং চট্টগ্রামে নতুন বিষয় নয়। ২০১৮ সালে কোতোয়ালী থানার জামালখানে আদনান হত্যার পর নগর পুলিশ অপরাধচক্রে জড়িত কিশোর এবং অপরাধপ্রবণ এলাকার তালিকা করেছিল। ঐ বছর কিশোর গ্যাংর বিরুদ্ধে ৩০০ স্পটে ৫৫০ কিশোর ছোট বড় কিশোর গ্যাং এর তালিকা করা হয়। এই ৫৫০ জনের তালিকা উঠে আসে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে কলেজিয়েট স্কুলের মেধবি ছাত্র আদনান ইসফার (১৫) হত্যার পর।
এর পরবছর ২০১৯ সালে নগরীতে এসব গ্যাং কালচারে জড়িত কিশোরের সংখ্যা ছিলো মোট ৫৩৫ জন। যাদের মধ্যে সিএমপির কোতোয়ালী থানায় সর্বোচ্চ ১৫০ জন কিশোর এসব গ্যাং কালচারে সম্পৃক্ত কথা জানা যায়। কিন্তু পতেঙ্গা ও কর্ণফুলীতে এরকম কোনও কিশোর গ্যাংয়ের নাম উঠে আসেনি সিএমপির করা ওই তালিকায়। সেই বছর প্রথম ৯ মাসে চট্টগ্রামে কিশোর অপরাধীদের হাতে খুন হয়েছে আরো ৭ জন। এ সময়ে কিশোর অপরাধের কারণে নগরের বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে ১৫টির বেশি। এমনকি এসব খুনে জড়িত তিনজন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহতও হয়েছে।
এই বছরও তাদের কোন ঘাটতি নেই। গত ২৮ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত র্যাব-পুলিশ নগরে অভিযান চালিয়ে ৪৪ জনকে আটক করে। তাদের কাছে ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত ছুরি, রড ও সুতা পাওয়া গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতে, নেশার টাকা জোগাড় করতে তারা ছিনতাই করে থাকে। আটক শিশু–কিশোরদের কিশোর সংশোধন ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।
বর্তমানে চট্টগ্রামে উড়ালসড়কে ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে যেসব শিশু-কিশোর ধরা পড়েছে, তাদের প্রায় সবারই জীবন ভাগ্যবিড়ম্বিত। সুস্থ ও স্বাভাবিক শৈশব বলতে যা বোঝায়, তা তারা পায়নি। এদের বেশির ভাগ বাস করছিল রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল বা ফুটপাতে। প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মূলত কিশোর গ্যাংই চট্টগ্রামের উড়ালসড়কে ছিনতাই করে থাকে।
ছিনতাই ও মাদক সেবন দুটোই গুরুতর অপরাধ। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত শিশু-কিশোরদের অপরাধী হিসেবে দেখা যাবে না। কোনটি অপরাধ আর কোনটি অপরাধ নয়, তা বোঝার বয়স তাদের হয়নি। সে ক্ষেত্রে সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানোর সিদ্ধান্ত সঠিক। কিন্তু সমস্যা হলো, দেশে শিশু-কিশোর সংশোধন কেন্দ্র নামে যে কটি প্রতিষ্ঠান আছে, কোনোটিই মানসম্মত নয়। প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবলও সেখানে নেই। যাঁরা এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন, তাঁরা অনেক সময় শিশু–কিশোরের সঙ্গে নির্দয় আচরণ করে থাকেন। ফলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এই অবস্থার দ্রুত অবসান হওয়া জরুরি।
প্রতিটি কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে উপযুক্ত বৃত্তিমূলক কাজের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে এখান থেকে বেরিয়ে কাউকে অনিশ্চিত পথে পা বাড়াতে না হয়। প্রত্যেক শিশু-কিশোরের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা দিতে হবে। কারও উপযুক্ত অভিভাবক না থাকলে রাষ্ট্রকে তার অভিভাবকের দায়িত্ব নিতে হবে। সব গণতান্ত্রিক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র তা করে থাকে। উন্নয়নের মহাসড়কে ওঠা বাংলাদেশ কেন সেই দায়িত্বটুকু পালন করবে না ?
রাষ্ট্রকে মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক শিশুর সুন্দর শৈশব ও কিশোরের সুন্দর কৈশোরই তাকে অপরাধ থেকে মুক্ত করতে পারে।