এম আর মাসুদ, আশাশুনি: বাবা মায়ের প্রথম সন্তান স্মৃতি। ঘরে তার আরও দু’টি ভাই বোন থাকলেও স্মৃতিকে ঘিরেই স্বপ্ন বুনে তার হতদরিদ্র বাবা- মা আর বৃদ্ধ দাদু। বাবা মা দু’জনই পেশায় দিন মজুর। জায়গা জমি বলতে তাদের শুধু ভিটে মাটি টুকুই। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির এই বাজারে সংসারে যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে শিক্ষা যেন প্রায় অকল্পনীয়ই ছিল। তবুও অদম্য মেধাবী স্মৃতি শত প্রতিকূলতার মাঝেও দারিদ্রকে জয় করেছে। ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস অর্জন করে প্রমান করেছে অদম্য ইচ্ছা শক্তি, কঠোর পরিশ্রম আর নিয়মিত অধ্যবসায় থাকলে শিক্ষার ক্ষেত্রে দরিদ্রতা কোন বাঁধা হতে পারে না। অদম্য মেধাবী এই স্মৃতি সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার কুল্যা ইউনিয়নের কচুয়া গ্রামের দিনমজুর জয়দেব মন্ডলের কন্যা। একেবারে অজো পাড়া গাঁয়ে গ্রামের শেষ সীমানায় বিলের সাথে তাদের বাড়ী। টালি দিয়ে ছাউনি বিশিষ্ট ছোট্ট দু’টি ঘর তাদের। এখানেই ৬ জনের কোনমতে বসবাস। আধুনিক বা ডিজিটাল কোন সুযোগ সুবিধা ছাড়াই একেবারেই নিজ প্রচেষ্ঠায় গোল্ডেন এ প্লাস অর্জন করেও অর্থের অভাবে আজ ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারছে না মেধাবী স্মৃতি। তার এই কৃতিত্বের কথা শুনে তার বাড়িতে ছুটে যায় এ প্রতিবেদক। সেখানেই কথা হয় তার ও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে। সেই কথপোকথন থেইে জানা যায় তার এই কৃতিত্ব, উচ্চ শিক্ষা অর্জনের প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর দারিদ্রতার কারনে ভালো কলেজে ভর্তি হতে না পারার আক্ষেপের কাহিনী। উপজেলার কুল্যা ইউনিয়নের কচুয়া বিএইচবিপি (বাহাদুরপুর, হামকুড়া, বাইনবসত, পুরোহিতপুর) আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে মানবিক বিভাগ থেকে গোল্ডেন এ প্লাস গ্রেডে পাশ করেছে স্মৃতি। নারী শিক্ষার এই বিদ্যাপীট থেকে এ বছর শতভাগ পাশ করলেও স্মৃতিই গোল্ডেন এ প্লাস প্রাপ্ত একমাত্র ছাত্রী। স্মৃতির একমাত্র ভাই তপন মন্ডল এ বছর ৬ষ্ঠ শ্রেণি এবং অপর বোন সাথী মন্ডল ৩য় শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে। ৬৬ বছরের বৃদ্ধ দাদু দুলাল মন্ডলও পায়না কোন বয়স্ক ভাতা। সংসার চালাতে অগত্যা স্মৃতির বাবা দেশ বিদেশে জন মুজুরী খাটতে যায়। কিন্তু তাতে সংসার খরচ, বৃদ্ধ শ^শুরের ঔষধ কেনা আর তিন ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ না চলায় স্মৃতির মা নমিতা মন্ডলও ভোর হলেই দিনমজুরী খাটতে বেরিয়ে পড়ে। পড়ালেখার পাশাপাশি সংসারের অনেক ঘানি টানতে হয় স্মৃতিকেও। তার এই কৃতিত্বের বিষয়ে জানতে চাইলে মেধাবী স্মৃতি এ প্রতিবেদককে জানায়, “বাবা মায়ের হাড় ভাঙা খাটুনি আর সংসারে অভাবের জোয়ার দেখে নিজেকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি। প্রতিদিন ৬/৭ ঘন্টা করে পড়ালেখা করেছি। স্কুলের ক্লাসগুলো নিয়মিত করেছি। স্কুলের স্যারদের সহযোগিতা ছাড়া স্পেশাল কোন কোচিং করার সুযোগ পাইনি। তবে বিশ^াস ছিল আমি পারব। তাই বিষয়ভিত্তিক একাধিক বই না থাকলেও বোর্ড বইগুলো ভালোভাবে পড়ার চেষ্টা করেছি। আর তাতেই এই সাফল্য পেয়েছি।” তার এই সাফল্য অর্জনের পেছনের অনুপ্রেরনা সম্পর্কে জানতে চাইলে মেধাবী স্মৃতি জানায়, “পরিবারে তার বাবা ও দাদু এবং স্কুলের শিক্ষকদের অনুপ্রেরনা তার এই কৃতিত্ব অর্জনে সহায়তা করেছে। সে আরও জানায়, স্কুলের স্যারদের মধ্যে প্রধান শিক্ষক কে এম আলমগীর মাহমুদ সব সময় তার পড়ালেখার বিষয়ে খোঁজ খবর নিতো। সহযোগীতা করতো। এছাড়া বাদশা স্যারও রিপন স্যার পড়ালেখার বিষয়ে বেশি বেশি সহযোগিতা করেছে। অন্যান্য স্যারেরাও অনুপ্রেরনা যুগিয়েছে।” ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে মেধাবী স্মৃতি জানায়, উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে আমি একজন আদর্শ শিক্ষক হতে চাই, দেশ ও দশের সেবা করতে চাই, আমার মতো গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় সহযোগিতা করতে চাই, সর্বোপরি বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করতে চাই। আর এজন্য আমি সাতক্ষীরা বা খুলনার একটি ভালো উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এইচএসসি ভর্তি হতে চাই। কিন্তু অর্থের অভাবে আমি ভর্তি হতে পারছি না।” স্মৃতির মা নমিতা মন্ডল জানায়, “ছোটবেলা থেকেই স্মৃতি খুব শান্ত স্বভাবের। পড়ালেখার প্রতি তার খুবই টান (আগ্রহ)। তাই নিজেরা ভালো না খেয়ে, ভালো কাপড় না পরে যতোটুকু পেরেছি ওর পেছনে খরচ করার চেষ্টা করেছি। ওর ইচ্ছাশক্তিই ওকে এই সাফল্য এনে দিয়েছে। এতে আমরা খুবই খুশি। তবে সামনে তার লেখাপড়াটা চালিয়ে নেয়ার মতো সামর্থ আমাদের নেই। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন বা কোন সহৃদয়বান ব্যক্তির সহযোগিতা পেলে ওর স্বপ্নটা পূরন হতো।” স্মৃতির বৃদ্ধ দাদু দুলাল মন্ডল এ প্রতিবেদককে জানায়, “স্মৃতি বড় হয়েছে, অগ্রহায়ন মাসে ওর বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু স্মৃতি যে ভালো রেজাল্ট করেছে তাতে করে ওকে এখন আর বিয়ে দেব না। প্রয়োজনে এই বৃদ্ধ বয়সে জন-মুজুরী খাটবো, তবুও ওকে লেখাপড়া করাবো।” সরকারিভাবে বা সামাজিকভাবে কিছু সহযোগিতা পেলে ভালো হয়।” কচুয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক কেএম আলমগীর মাহমুদ এ প্রতিবেদককে বলেন, স্মৃতি অত্যন্ত বিনয়ী, নম্র, ভদ্র ও ঠান্ডা প্রকৃতির মেয়ে। সে নিয়মিত ক্লাস করতো এবং বুঝে পড়ার চেষ্টা করতো। সে অত্যন্ত মেধাবী এবং দরিদ্র পরিবারের সন্তান। লেখাপড়ার বিষয়ে সহযোগিতার হাত নিয়ে যদি তার পাশে দাড়ানো যায় তাহলে আগামীতে সে দেশের একটা সম্পদ হতে পারে।” অদম্য মেধাবী স্মৃতি’র ভালো কলেজে ভর্তে হওয়ার এই বাঁধা কিভাবে দুর হবে সেটাই এখন তার পরিবারের প্রধান চিন্তা। শত প্রতিকূলতাকে জয় করেও স্মৃতির উচ্চ শিক্ষা লাভের উচ্চাকাঙ্খা যেন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে না যায়, গোল্ডেন এ প্লাস যেন স্মৃতির জীবনে শুধুই স্মৃতি হয়ে না থাকে এজন্য ভালো কলেজে ভর্তি হওয়া ও তার লেখাপড়ার খরচ যোগাতে সরকারিভাবে বা সমাজের শিক্ষানুরাগী বিত্তবানদের তার পাশে দাড়ানো বিশেষ প্রয়োজন বলে মনে করেন তার সহপাঠীসহ এলাকাবাসী।