মহারাজ কৃষচন্দ্রের রাজদরবারে মহা উত্তেজনা! উজির নাজির পাত্র অমাত্য সাধারণ সভাসদসহ সকলের মধ্যেই বিপুল উৎকণ্ঠা। মন্ত্রী বিড়বিড় করিয়া মন্ত্র উচ্চারণের মতো কী যেন অস্ফুটকণ্ঠে বলিয়া চলিয়াছেন এবং অস্থিরভাবে পায়চারি করিতেছেন আর কখনো কখনো হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করিয়া আকাশে ছুড়িয়ে দিতেছেন। গোপাল ভাঁড় লক্ষ করিতেছিল, মন্ত্রীমহাশয় কখনো কখনো লোলুপদৃষ্টিতে আবার কখনো আর্তচোখে শূন্য সিংহাসনের দিকে দৃষ্টিপাত করিতেছেন।
ঠিক এই সময় মহারাজের আগমনবার্তা উচ্চারিত হইল‘জয় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের জয়।’ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রাজসভায় প্রবেশ করিলেন এবং সিংহাসনে উপবেশন করিলেন। কিছুক্ষণ উপস্থিত সভাসদদের ওপর চোখ বুলাইয়া মেঘমন্দ্রিত কণ্ঠে কহিলেন, “সবাই এসেছ তো! তাহলে এবার রাজসভার কাজ শুরু হোক। হ্যাঁ, শোনো আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত আমাকে নিতে হচ্ছে। এ কথা ঠিক যে, আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করে চলেছি যাতে প্রজাদের মুখে সবসময় হাসি থাকে, যাতে প্রজাদের মনে কোনো কষ্ট না থাকে, কারও যেন কোনো অভিযোগ না থাকে”।
মন্ত্রী এই সময় উসখুস করিতে থাকিলে উহা মহারাজের দৃষ্টিগোচর হইল। তিনি বলিলেন,“কী মন্ত্রী, হঠাৎ তুমি এত ছটফট করছ কেন, একটা জরুরি বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছি আর তুমি মাঝখানে বাগড়া দিচ্ছ কেন?
না, মহারাজ বাগড়া দিচ্ছি না তো, একটা ভালো কিছু শুনলে তো মনটা প্রফুল্ল হয়ে ওঠে, তাই আর কি!
গোপাল মন্ত্রীমশাই বেশ খুশি হবেনই, মহারাজ। প্রজাদের কোনো উন্নতি হলে তো মন্ত্রীমশাইয়েরও ভাগ্য প্রসন্ন হয়।
মন্ত্রী দেখলেন, দেখলেন মহারাজ, গোপাল আমাকে কেমন খোঁচা দিয়ে কথা বলছে।
গোপাল আমি খোঁচা দিলাম কোথায়! মন্ত্রীমশাই তো বলেন, তার অবস্থান মহারাজের পরেই। কাজেই রাজ্যে যদি উন্নতি কিছু হয়, প্রজাদের যদি মঙ্গল হয়, তার কৃতিত্ব কি তারও নয়? আমি তো সে কথা বললাম এখন মন্ত্রীমশাইয়ের মনে কী হচ্ছে তা তো আমি জানব না, মহারাজ।
কৃষ্ণচন্দ্র আহ্, থামবে তোমরা? একটু কিছু হলেই কী যে গোল বাধাও তোমরা! ইচ্ছে করে চুপ করো সবাই, আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি এখন, কেউ কোনো কথা বলবে না। শুধু শুনবে আর সেই অনুযায়ী কাজ করবে। তোমরা তো একটা কথা নিশ্চয়ই মানবে যে, এখন যুগটা পাল্টাচ্ছে। এক মন্ত্রীর ওপর তো আর সব দায়দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া যায় না, তারও তো বয়স হচ্ছে। তাই আমি সবাইকে কাজ ভাগ করে দেব প্রত্যেকের এক একটা বিভাগ থাকবে কারও থাকবে আইন বিভাগ, কারও অর্থ বিভাগ, কারও স্বরাষ্ট্র বিভাগ, মৎস্য বিভাগ, সংস্কৃতি বিভাগ এই রকম। হ্যাঁ, বলো মন্ত্রী, তুমি আবার কী বলতে চাইছ?
মন্ত্রী মহারাজ, তাহলে আমার তো বেশ ক্ষতি হয়ে যাবে। আপনার পরেই তো আমার অবস্থান থাকার কথা। আমাকে যদি কোনো পরিকল্পনা করার জন্য সবার কাছে ধরনা দিতে হয়, তাহলে তো কোনো কাজই এগোবে না, মাঝখান থেকে রাজ্যটাই রসাতলে যাবে। তাই আমি বলছি কি মহারাজ, আগে যেভাবে চলছিল, সেভাবেই চলুক।
গোপাল মহারাজ আপনার সিদ্ধান্তই যুক্তিসংগত। এর ফলে রাজ্যসভার সব সদস্যের মনে বল আসবে, দায়িত্ববোধ তৈরি হবে, সৎ চিন্তা আসবে, দুর্নীতি দূর হবে।
মন্ত্রী থামো থামো গোপাল, তোমার আর লেকচার করতে হবে না। লেখাপড়ার মুরোদ নেই, শিক্ষাদীক্ষা নেই, আছে শুধু বড় বড় কথা। মহারাজকে অকর্মণ্য রাখার জন্য এটা বোধহয় তোমারই ফন্দি। মহারাজের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার কৌশল।
গোপাল তা যা বলেছেন মন্ত্রীমশাই, সবকিছুতেই আপনার বখরার ভাগ যদি আর না পান, এ জন্যই এত অধীর হয়ে পড়েছেন বুঝি। একটা কথা আছে না, ‘যার ধন তার ধন নয় নেপোয় মারে দই’ আপনি তো সেই নেপোর ভূমিকায় আছেন ষড়যন্ত্রী থুড়ি মন্ত্রীমশাই!
মহারাজ আবার কী শুরু করলে তোমরা। থামো, থামো বলছি। হ্যাঁ, মন্ত্রী, তুমি বলো সেদিন নির্বাচন না নির্যাতন কী একটা বলছিলে তুমি, সেটার কথা বলো, কী বুঝাতে চেয়েছিলে তুমি?
মন্ত্রী মহারাজ, আমি তো না, মুর্শিদাবাদের নবাব সাহেব বলছিলেন যে, কৃষ্ণচন্দ্রের তো অনেক বয়স হলো, এখন সিংহাসনটা অন্য কারও হাতে ছেড়ে দিলেই তো হয়। এই ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারটা একটা নিয়মের ভেতর দিয়ে করা যেতে পারে, সেই নিয়মটা বিলেতে ওই সাহেবদের দেশে আছে—
কৃষ্ণচন্দ্র সেটা কী রকম?
মন্ত্রী—খুবই সহজ নিয়ম মহারাজ, ধরে নিন, কৃষ্ণনগরে একটা নির্বাচন হলো—আপনি রাজা, আপনি একদিকে আর আমি মন্ত্রী—আমি অন্যপক্ষে। প্রজারা সবাই ভোটার—মানে ভোট দেবে— তারা সিংহাসনে কাকে রাজা হিসেবে দেখতে চায় আপনাকে না আমাকে! যার বাক্সে বেশিসংখ্যক ভোট পড়বে সেই-ই হবে রাজা।
মহারাজ তার মানে? আমি আর কৃষ্ণনগরের রাজা থাকব না? আর তুমি-তুমি-তুমি-ব্যাটা মন্ত্রী হবে রাজা? এত বড় আস্পর্ধা।
মন্ত্রী মহারাজ, এত উত্তেজিত হবেন না আমি শুধু বলেছি নির্বাচন কী জিনিস আর কীভাবে করতে হয়। আর তাছাড়া মুর্শিদাবাদের নবাবও সায় দিয়েছেন আর দিল্লির বিলিতি সাহেবরা পরিষ্কার বলেই দিয়েছেন, কৃষ্ণনগরের সিংহাসনে কৃষ্ণকান্তকে বদলাতেই হবে কৃষ্ণচন্দ্রকে হারানো হবেই হবে।
কৃষ্ণচন্দ্র কী বলছ মন্ত্রী! তুমি এত খবর জানলে কী করে? সাহেবদের সঙ্গে কি দেখা হয়েছে তোমার?
মহারাজের এ প্রশ্নে মন্ত্রী একটু ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া গেল। বারবার ঢোক গিলিয়া আমতা আমতা করিয়া বলিল
মন্ত্রী না-না! মানে ইয়ে মানে আমার দেখা হবে কী করে?
গোপাল এবার উঠিয়া দাঁড়াইল।
গোপাল মহারাজ, মন্ত্রীমশাই তো কিছু ইংরেজি জানেন যেমন অন্তত ইয়েস, নো, ভেরিগুড কথাগুলো তো বলতেই পারেন। সে জন্য বিলিতি সাহেবদের সঙ্গে তার কিছু কিছু ব্যবসা-বাণিজ্যও আছে কি না, তাই সহজ হয়।
মন্ত্রী সাবধান গোপাল, একদম মিথ্যে কথা বলবে না, তোমার বড্ড বেশি বাড় বেড়েছে, মহারাজের আশকারা পেয়ে পেয়ে তুমি ধরাকে সরা জ্ঞান করছ, তাই না? তোমার দিন ফুরিয়ে আসবে, এই বলে দিলাম।
গোপাল সে কি মন্ত্রীমশাই, এত রেগে যাচ্ছেন কেন? মিথ্যে কথা আমি বললাম কোথায়?
মন্ত্রী কেন? এইমাত্র তুমি বললে না যে আমার সঙ্গে বিলেতের সাহেবদের ব্যবসা-বাণিজ্য আছে? এই ডাহা মিথ্যে তুমি মহারাজের সামনে, সবার সামনে বললে কী করে?
গোপাল আপনি তো অযথা চটে যাচ্ছেন মন্ত্রীমশাই, এ কথা তো আমি বলিনি বলেছে আপনার দুই চোখের মণি কটা আর ঘটা। কবে কবে দেখা হয়েছে ওদের সঙ্গে আপনার এসব কটা-ঘটা খুব যতেœ লিখে রেখেছে। পেয়াদা পাঠিয়ে ওদের এই দরবারে আনুন ওরা সব প্রমাণ দিয়ে দেবে। আর আমার নাতি-নাতনিদেরও আমি সাক্ষী হিসেবে এখানে আনব, ঠিক আছে মন্ত্রী মশাই?
মন্ত্রীর প্রায় মূর্ছা যাওয়ার দশা! মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র অস্থির হইয়া বলিলেন, আজ সভার কাজ এখানেই শেষ। আগামী দিন এ নিয়ে আরও অনেক কথা হবে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা