নিজস্ব প্রতিবেদক: “ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন”, “মায়ের পেটের ভাই, কোথায় গেলে পাই ?” – এ জাতীয় কথা আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে। তথাপি ভাই ভাইকে হত্যা করে, মারপিট করে, ভাই ভাইয়ের সম্পত্তি ফাঁকি দিয়ে খায়, অবৈধভাবে জবরদখল করে নেয় – এ ধরনের ঘটনাও আমাদের সমাজে ঘটতে দেখা যায়। এমনই একটি অমানবিক ঘটনা ঘটেছে সাতক্ষীরার কুখরালিতে। রক্তের টান আর মানবিকতার খাতিরে নিজ জমি থেকে অপর ভাইদের জমি লিখে দিলেও প্রতিদানে সেই ভাইয়েরাই রক্তের বাঁধনের দিকে না তাকিয়ে মানবিকতাকে বিসর্জন দিয়ে ভাইয়ের জমি অবৈধভাবে লিখে নিয়ে জবরদখল করছে। ভাই সহ তার পরিবারের লোকজনদেরকে মারপিট করে আহত ও রক্তাক্ত জখম করার মতো অকল্পনীয় ঘটনাও ঘটিয়েছে। এ নিয়ে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, বিচার শালিস, জিডি, মামলা, নোটিশ সবই হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু জমির প্রকৃত মালিক তার জমি বুঝে পাচ্ছে না। উপরোন্ত নানারকম হুমকি-ধামকি, মারপিট ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। তাই নিজ জমির দখল বুঝে পেতে এবং হয়রানী থেকে রক্ষা পেয়ে নিরাপদে বসবাসের নিশ্চয়তার জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে ভূক্তভোগী ভাই ও তার পরিবারের সদস্যরা।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সাতক্ষীরা পৌরসভাধীন কুখরালী গ্রামের বাসিন্দা মৃত করিম বক্স মোড়লের ৫ পুত্র আশরাফ আলী, আমজেদ আলী, মোকছেদ আলী, সেকেন্দার আলী ও শামছুর। আশরাফ আলী জানান, পৈত্রিকভাবে তাদের তেমন সম্পত্তি না থাকায় তিনি কুখরালী গ্রামের মৃত আব্দুল গফুর এর পুত্র ইয়াকুব আলীর নিকট থেকে ১৪ জুলাই ১৯৮০ সালে ৮৪৫৫ নং কোবলা দলিল মূলে রামদেবপুর মৌজায় ১৬ শতক জমি খরিদ করেন, যার জেএল নং ৯৬, এসএ ১১৮ দাগ ২১৯২, দাগ ৪২০৮ খতিয়ান নং ১২৭। উক্ত জমি হতে ৩ শতক করে মোট ৯ শতক জমি বিগত ৩১ আগস্ট ১৯৮৩ সালে ৮০৮৩ নং দলির মূলে আশরাফ আলী তার তিন ভাই আমজেদ, মোকছেদ ও সেকেন্দার এর নামে লিখে দেন। ফলে ১১৮/২ নং হাল খতিয়ানে আশরাফ আলীর নামে ৭ শতক জমি অবশিষ্ট থাকে। ইতোমধ্যে তাদের এক ভাই সেকেন্দার আলী মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৯১ পর্যন্ত আশরাফ আলী উক্ত জমির খাজনা পরিশোধ করে ভোগ দখল করে আসছিল। কিন্তু আমজাদ ও মোকছেদ তাদের নামীয় ৩ শতক করে মোট ৬ শতক ও মৃতু সেকেন্দার এর নামী ৩ শতক জমি সহ ৯ শতক এবং আশরাফ আলীর অংশ হতে কৌশলে ২ শতক জমির রেকর্ড কর্তন কওে সর্বমোট ১১ শতক জমি ১৫৮২ নং খতিয়ানে তাদের নামে রেকর্ড সৃষ্টি করে এবং বিষয়টি গোপন রাখে। দীর্ঘ ৩০ বছর পর জালিয়াতির বিষয়টি বুঝতে পেরে উক্ত জমির রেকর্ড সংশোধনের জন্য আশরাফ আলী বিগত ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তারিখে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবুনালে ১০১৯/১৮ নং মামলা করে। এরপর রেকর্ড সংশোধন করে জমি ফেরৎ দেয়ার জন্য বিগত ২১/১১/২০১৯ তারিখে উভয় পক্ষকে নিয়ে একটি আপোষনামা করা হয়। সে আলোকে তারা জমি ফেরৎ দেয় কিন্তুকিন্তু আজ পর্যন্ত তারা উক্ত জমির দখল বুঝে না দিয়ে গায়ের জোরে অবৈধভাবেব তারা উক্ত জমি জবরদখল করে রেখেছে বলে জানায় আশরাফ আলী। এ বিষয়ে তাদেরকে কিছু বললেই তারা আশরাফ আলী ও তার পরিবারের লোকজনকে মারপিট ও খুন জখমের হুমকি দিয়ে থাকে। এর প্রেক্ষিতে আশরাফ আলী নিজের ও তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তাহীনতায় বিগত ২০/১২/২০১৬ তারিখে থানায় ২৩৯ নং একটি সাধারণ ডায়েরী করে। এভাবে চলতে থাকে তাদের ভাই ভাইয়ের মাঝে বিরোধ।
লিখিত এজহার মতে জমি বিরোধের এই জের ধরে বিগত ২৮ মে ২০২০ তারিখে (রমজান মাসে) বাদানুবাদের এক পর্যায়ে প্রতিপক্ষের মোকছেদ আলী, তার পুত্র মাছুম, স্ত্রী মমতাজ, আমজেদ আলীর পুত্র খোকন ও ইব্রাহিম, শামছুর রহমান, তার পুত্র মারুফ, কন্যা আঞ্জুয়ারা, ও আছমা খাতুন গং আশরাফ আলীকে মারপিট করে। তাকে ঠেকাতে গেলে আশরাফ আলীর কন্যা সাথী, বুলবুলি, পুত্র আলী হোসেন ও জামাতা করিমকে লাঠিসোটা ও লোহার রড দিয়ে এলোপাতাড়ি মারপিট করে গুরুতর আহত করে। এতে করিম রক্তাক্ত জখম হয়। আহত সবাইকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় আশরাফ আলী কন্যা সাবিনা ইয়াসমিন সাথী বাদী হয়ে থানায় লিখিত এজাহার দাখিল করলে ২৯/০৫/২০২০ তারিখে ৫৬ নং একটি মামলা এন্ট্রি হয়। তদন্তে ঘটনার সত্যতা প্রমানিত হওয়ায় মামলাটির চার্জশিট হয়।
পরবর্তীতে বিগত ০৮/০৩/২১ তারিখে মোকছেদ, তার পুত্র মাসুম বিল্লাহ ও আমজেদ এর পুত্র ইব্রাহিম সহ অন্যান্যরা আশরাফ আলীর বসত ভিটায় জোরপূর্বক অনধিকার প্রবেশ করে ঘেরা বেড়া ও টিনের চাল সহ ঘর নির্মানের পায়তারা করে। এ ঘটনা উল্লেখ করে থানায় লিখিত প্রতিকার প্রার্থনা করেন আশরাফ আলী।
এসব নিয়ে প্রতিপক্ষ মোকছেদ বিভিন্ন ব্যক্তিকে নিয়ে একবার এবং আশরাফ আলীকে পূর্ব থেকে কিছু না জানিয়ে গত ১৪ মার্চ ২১ তারিখে শতাধিক লোক নিয়ে হুট করে তার বাড়িতে যেয়ে সেদিনই এ বিষয়ে বিচার হবে বলে জানায়। এ ঘটনায় পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার শহিদুল ইসলাম ও বর্তমান ওয়ার্ড কমিশনার মারুফ হোসেনও উপস্থিত ছিলেন বলে আশরাফ আলীর পরিবার নিশ্চিত করে।
এদিকে এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রতিকার প্রার্থনা করে আশরাফ আলী বিগত ১৬/০৩/ ২০ তারিখে বিজ্ঞ দেং অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৪৫ ধারা মতে ৫৫৬/২১ নং মামালা দায়ের করে। এতে করে সাতক্ষীরা সদর থানা ওসি’র নির্দেশক্রমে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার লক্ষ্যে এসআই রবিন গত ১৭ মার্চ ২১ তারিখে উভয়পক্ষকে নোটিশ জারি করে।
কিন্তু আশরাফ আলী তাদের চলাচলের পথ বন্ধ করে দিচ্ছে এরুপ অসত্য অভিযোগ করে এর প্রতিকার চেয়ে সুচতুর মোকছেদ, আমজেদ, সামছুর গং গত ১ এপ্রিল ২০২১ তারিখে সাতক্ষীরা পৌর মেয়র বরাবর একটি দরখাস্ত করে। এতে করে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর ০৬/০৪/২১ তারিখে পৌরসভা অফিসে উহার শুনানীর দিন ধার্য করে নোটিশ জারি করে।
অথচ সরেজমিনে দেখা গেছে, আশরাফ আলীর ঠিক ঘরের সামনে দিয়েই অপর ভাইয়েরা সাইকেল, ভ্যান গাড়ী নিয়ে যাতায়াত সহ তাদের পরিবারের লোকজন প্রতিনিয়ত চলাচল করে থাকে।
এ ব্যাপরে আশরাফ আলী বলেন, আমার ভাইয়েরা গোপনে আমার ২ শতক জমি লিখে নেয়। পরে তা খাতাকলমে ফিরিয়ে দিলেও আমাকে তা ভোগ দখল করতে দিচ্ছে না। তারা তা জবরদখল করে রেখেছে। আমি পরিবার নিয়ে আমার ঘর বাড়িতে বসবাস করি। আমার ঘরের ঠিক সামনে দিয়েই তারা ভ্যান, সাইকেল নিয়ে চলাচল, মালামাল বহন এমনকি বাইরের লোকজনও প্রয়োজনে তাদের বাড়িতে এখান দিয়েই যাতায়াত করে থাকে। এতে করে আমার পরিবারের মহিলাদের সহ অন্যান্যদের নানাভাবে অসুবিধা হয়ে থাকে। তাছাড়া জমির প্রকৃত মালিক আমি, যা নিয়ে মামলা চলমান আছে। কিন্তু বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য এবং আমাকে হয়রানী করার জন্য পথ বন্ধ করার ভিত্তিহীন অভিযোগ করেছেন।
তার বক্তব্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, আশরাফ আলীর উঠান দিয়েই অভিযোগকারীরা আজও চলাচল করছে। সেটি মূলত উঠান, সেখানে চলাচলের আলাদা কোন পথ নেই্ এবং আশরাফ আলী উঠান দিয়ে চলাচলের এই জায়গাও বন্ধ করেননি।
এ ব্যাপারে আশরাফ আলী ও তার পরিবারের সদস্যরা তাদের ন্যায্য পাওনা জমি বুঝে পাওয়ার জন্য প্রশাসন ও আদালতের কাছে ন্যায় বিচারের দাবী জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে আমজাদ, মোকছেদ গং দের বক্তব্য জানার জন্য ফোন করা হলে আমজাদ হোসেনের ছেলে মোস্তফা মাহমুদ খোকন ফোন রিসিভ করেন এবং উক্ত বিরোধপূর্ণ ২ শতক জমির মালিক আশরাফ আলী বলে স্বীকার করেন। তবে তিনি বলেন, আমার চাচা আশরাফ আলী আমাদেরকে তার উঠান দিয়ে চলাচলের জন্য বলেন সে মোতাবেক আমরা সেখান দিয়ে চলি। কিন্তু তিনি ও তার মেয়ে , জামাইরা মিলে আমাদের চলাচলের পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই এ নিয়ে আমাদের বিরোধ চলছে। এ ব্যাপাওে আমরা পৌরসভায় অভিযোগ করেছি আগামী ৬ এপ্রিল মঙ্গলবার যার শুনানীর দিন ধার্য আছে।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বেশ কয়েকজন বলেন, আশরাফ আলী উঠান দিয়েই তার অন্যান্য ভাইয়েরা চলাচল করছে। আদালতে ১৪৫ ধারায় মামলা চলমান থাকা সত্ত্বেও প্রতিপক্ষকে হয়রানী করার জন্য তারা পৌরসবায় অহেতুক অভিযোগ করেছেন। তারা বলেন, ভাই হয়ে ভাইয়ের জমি গোপনে লিখে নেয় আবার তা ফেরৎ দিলেও ভোগদখল করতে না দেয়ার বিষয়টি আমাদের হতবাক করেছে।
এ ব্যাপারে ৬ নং ওয়ার্ড কমিশনার মারুফ হোসেনের সাথে কথা হলে তিনি জমি নিয়ে বিরোধের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, রেকর্ড ফেরৎ না দিয়ে থাকলে উক্ত ২ শতক জমির মালিক বর্তমান ভোগদখলকারীরাই। আর কাগজ কলমে ফেরৎ দিলে বা বিষয়টি মীমাংসা হয়ে গেলে প্রতিপক্ষ জমির মালিক বলে দাবী করতে পারে। এই জমির জন্য মোকছেদ, আমজাদ গং আশরাফ আলীকে বিগত দিনে কিছু টাকা দিয়েছে বলে দাবী করে। কিন্তু আশরাফ আলী এই টাকা গ্রহন করেনি বলে দাবী করে। তিনি বলেন, বিষয়টি আমি সহ অন্যান্য মীমংিষা করার জন্য চেষ্টা করেছি কিন্তু কোন পক্ষ ছাড় না দেয়ায় তা সম্ভব হয়নি। যার ফলে বিষয়টি নাকি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে বলে আজই জানতে পেরেছি। পথের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার জানা মতে আসলে সেটি কোন নির্দিষ্ট পথ নয়। বাড়ির উঠানের উপর দিয়েই তারা ভাই ব্রাদার হিসেবে চলাচল করে। যা বাড়ী ওয়ালার জন্যও অনেকসময় বিব্রতকর হতে পারে। মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় নোটিশ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আবেদনের প্রেক্ষিতে মীমাংসার লক্ষ্যে নোটিশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে মামলা আছে আমাদের আগে জানা ছিল না। বিষয়টি মীমাংসা হওয়া দরকার বলে তিনি নিজেও অভিমত ব্যক্ত করেন।