
মাসুদুর রহমান মাসুদ, প্রতাপনগর (আশাশুনি)থেকে ফিরে: একজন গুনী শিল্পীর মাঝে যেসব গুণাবলী থাকা প্রয়োজন তার প্রায় সবগুলোই রয়েছে তার মাঝে। যে কোন কিছু দেখেই রং তুলির আঁচড়ে হুহহু এঁকে দিতে পারেন তিনি। তার আঁকা বহু শিল্পকর্ম হোটেল শেরাটন, গুলশান, হানাশান ও টিভোলি আর্ট গ্যালারী সহ বাংলাদেশের নামীদামী বিভিন্ন গ্যালারীতে শোভাবর্ধণ করে চলেছে। দেশ ও দশের জন্য কিছু করতে চান এই পটুয়া। কিন্তু নিজ সক্ষমতা আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারছে না এই চিত্র শিল্পীর প্রতিভা। সরকারি বা বেসরকারি যেকোন ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে চারুশিল্প জগতে তিনি হয়ে উঠতে পারেন সাতক্ষীরা জেলার অন্যতম মডেল।
গুনী এই চিত্র শিল্পীর নাম মনি। পুরো নাম জারজীস কবীর মনি। বেড়ে উঠেছেন সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর গ্রামে। কৃষিজীবী পিতা মরহুম লুৎফর রহমান ও গৃহীনি মাতা সখিনা বিবি’র একমাত্র সন্তান তিনি। জন্ম ১৯৬২ সালের ১২ই ডিসেম্বর। বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল ছেলে লেখাপড়া শিখে বড় চাকুরিজীবী হবে। কিন্তু ছোট বেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল তার। তাইতো নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ তিনি চিত্র শিল্পী। এক সময় রং তুলির আঁচড়ে ভাল উপার্জন করলেও বর্তমানে তার এই পেশায় চলছে ভাটা। এখন আর আগের মতো অর্ডার পান না তিনি। তাইতো ঢাকা ফেরৎ এই শিল্পীর দিন কাটছে নিদারুন কষ্টে।
গুণী এই শিল্পীর সাথে কথা বলে জানা যায়, পিতৃভিটা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার আটুলিয়া ইউনিয়নের তালবাড়িয়া গ্রামে হলেও ছোট বেলা থেকেই আশাশুনির প্রতাপনগর গ্রামে নানার বাড়িতে প্রতিপালিত হয়ে বেড়ে ওঠেন তিনি। নওয়াবেকী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক ও চাঁদনীমুখা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে এসএসসি পাশের পর অভাবের কারনে কয়েক বছর লেখাপড়া করতে পারেননি তিনি। এ সময় বাড়ীতে বেকার ঘুরে বেড়াতেন আর বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলে বেড়াতেন মনি। কিন্তু মনে-মনে লালন করতেন চিত্র শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন। তাইতো ১৯৮৫ সালে ঢাকায় যেয়ে হোটেল সুন্দরবনে আর্টিস্ট কাম ওয়েটারের চাকুরী নেন। ১৯৮৮-৮৯ সেশনে পুরান ডাকার ওয়াইজঘাটের বুলবুল একাডেমি অফ ফাইন আর্ট (বাফা) এ ড্রইং এন্ড পেইন্টিং কোর্সে ভর্তি হন। সেখান থেকে প্রি ডিগ্রী ও বিএফএ ডিগ্রী লাভ করেন। প্রি ডিগ্রীতে ফাস্ট ক্লাস সেকেন্ড ও বিএফএ ডিগ্রীতে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট হন তিনি। ১৯৯৪ সালে সেখান থেকে পাস করে বের হন এবং ঐ একই বছরে ছবি আঁকার উপরে ন্যাশনাল ড্রইং এ্যান্ড পেইন্টিং এক্সিভিশন এ অংশগ্রহণ করেন তিনি।
এরপর ফ্রিল্যান্স আর্টিস্ট হিসেবে ফিউচার স্টাডিস এর জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছবি এঁকে বেড়ান। ২০০০ সাল থেকে ঢাকার গুলশান আর্ট গ্যালারী, হানাশান আর্ট গ্যালারী, টিভোলি আর্ট গ্যালারী, সাজু আর্ট গ্যালারী ও হোটেল শেরাটন সহ বিভিন্ন জায়গায় ছবি এঁকে দিয়ে সামান্য কিছু উপার্জন করতে থাকেন তিনি। সেখানে ছেলে-মেয়েদেরও অঙ্কন শেখাতেন তিনি। এভাবে তার দিন কাটতে থাকে ঢাকায়।
২০০৮ সালে প্রতাপনগর গ্রামে রাবেয়া খাতুনকে বিয়ে করে জীবনের নতুন ইনিংস শুরু করেন মনি। সেই থেকে মাঝে মাঝে ঢাকায় আর মাঝে মাঝে বাড়ীতে থাকেন তিনি। বর্তমানে বাড়ী বসে ছবি এঁকে কুরিয়ার সার্ভিস যোগে ঢাকায় পাঠান। কিন্তু পারিশ্রমিক পান খুবই কম। ফুল শিট (২৮/২২ ইঞ্চি) কাগজের ছবির পারিশ্রমিক ২ হাজার টাকা, হাফ শিট (১৪/২২ ইঞ্চি) কাগজের ছবির পারিশ্রমিক ১ হাজার টাকা এবং কোয়ার্টার শিট (৭/১১ ইঞ্চি) কাগজের ছবির পারিশ্রমিক ৫শ’ টাকা বলে জানান তিনি। তবে সারা বছর এই কাজের অর্ডার পান না তথা চাহিদা থাকে না বলে জানান এই শিল্পী। এরই মাঝে মহামারী করেনা ভাইরাসের আগমন ঘটায় ছবি আঁকার অর্ডার একেবারেই কমে যায় তার।
বৃদ্ধা মা, স্ত্রী, পুত্র আর এক কন্যাকে নিয়ে ৫ জনের সংসার তার। ছেলে আলিয়াম জারসীস ৪র্থ শ্রেনীতে আর মেয়ে মোহসীনা কবীর প্লে শ্রেনীতে লেখাপড়া করছে। বৃদ্ধা মায়ের ঔষধ ক্রয়, ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ আর সংসার খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। কারন শুধু ছুবি এঁকেই সংসার চালাতে হয় তাকে। নিজস্ব কোন জায়গা জমি না থাকায় বর্তমানে পরিবার পরিজন নিয়ে প্রতাপনগরের কুড়িকাহনিয়া গ্রামের হাসান মাঝির বাড়িতে ভাড়ায় বসবাস করছেন তিনি। কিন্তু গত ২০ মে সুপার সাইক্লোন আম্ফানে প্রতাপনগরের বিভিন্ন পয়েন্টে ওয়াপদার বেড়ীবাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয় ইউনিয়নের বিস্তীর্ন এলাকা। ফলে তার ভাড়া বাড়িতেও চলছে জোয়ার ভাটার খেলা। করোনা মহামারী, ঘূর্নিঝড় আম্ফানের ক্ষয়ক্ষতি আর আর্থিক অস্বচ্ছলতায় বর্তমানে নিদারুন কষ্টে দিনাতিপাত করছে এই শিল্পী পরিবারটি।
গুনী এই চিত্র শিল্পীর স্ত্রী রাবেয়া খাতুন বলেন, আমাদের নিজস্ব কোন আশ্রয় নেই, পুঁজি নেই, এক শতাংশ জমিও নেই। ছবি এঁকে যা আয় করে তা মনে হয় বীজ ধান বিক্রি করে খাওয়ার মতোই। করোনার এই চার মাসে মনে হয় পৃথিবীর সকল মানুষের চেয়ে আমরা বেশী কষ্টে আছি।” তিনি বলেন, “আমি নিজে লেখাপড়া জানি, কিন্তু শিক্ষাকে কাজে লাগাতে পারছিনা। আমি দর্জি কাজ জানি কিন্তু ঘরে ঘরে মেশিন হওয়ায় তেমন কোন অর্ডারও পাই না। ৪ বছর ভাড়া বাড়িতে আছি, এখানে কারো কাছে সাহায্য চাইতে গেলেও পাই না। আজ (০৩ জুলাই) আমার আব্বা একশ’ টাকা দিয়েছে তা দিয়েই বাজার করেছি। সবমিলে খুবই কষ্টে দিন কাটছে আমাদের।”
শিল্পী মনি’র শিশু কন্যা মোহসীনা জানায়, “ভালো জামা এবং খাবার খেতে চাইলে মা প্রায়ই বকা দেয়।”
একান্ত সাক্ষাৎকারে এই চিত্র শিল্পী বলেন, “দেশের বিখ্যাত ব্যক্তিদের সারিতে দাঁড়ানোর স্বপ্ন ছিল আমার, কিন্তু পুঁজি না থাকায় কিছুই করতে পারছি না। মনের লালিত স্বপ্ন আর অর্জিত জ্ঞানকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছি না। সরকারি/বেসরকারি পৃষ্টপোষকতা পেলে দেশ ও দশের জন্য কিছু অবদান রাখতে চাই আমি।”
প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন বলেন, মনি একজন ভাল শিল্পী, প্রতিষ্ঠিত হতে হলে তাকে বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ রাখতে হবে। তাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে পারলে সে আরও ভাল কিছু করতে পারবে। আশাশুনি তথা সাতক্ষীরা জেলার জন্য সে সুনাম বয়ে আনতে পারবে।
তাই অজো পাড়া গাঁয়ে পড়ে থাকা এই চিত্র শিল্পীকে পৃষ্টপোষকতা দিয়ে দেশের চিত্রকর্মকে বাঁচিয়ে রাখতে সমাজের সহৃয়বান ব্যক্তি, আশাশুনি উপজেলা নির্বাহি অফিসার, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক সহ প্রশাসনিক অন্যান্য কর্তা ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন সচেতন এলাকাবাসী।