
কামরুল হাসান।। প্রতিমা তৈরিতে নতুনত্ব যেন কলারোয়ার উত্তর মুরারিকাটি পালপাড়ার চিরাচরিত বৈশিষ্ট। দুর্গাপূজায় প্রতিমার শোভাবর্ধনে নতুনত্ব তাদের প্রতিবারই থাকে। প্রতিমার জৌলুসে ব্যতিক্রমী সৃষ্টিশীলতায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারা প্রবর্তন করা হয়ে থাকে এখানে। এরই ধারাবাহিকতায় এবার পালপাড়ার পূজা আয়োজকরা বাংলাদেশের স্বর্ণসূত্র পাটের সোনালি আঁশ বসিয়ে দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করিয়েছেন। ২০২৩ সালে চিনিগুঁড়া ধান দিয়ে তৈরির পর গত বছরও বিশেষ লুকে প্রতিমা তৈরি হয়। আর এবার এখানে সবগুলো প্রতিমায় বিশেষ পদ্ধতিতে পরিষ্কার পাটের আঁশ বসিয়ে প্রতিমার শোভাবর্ধন করা হয়েছে। গোটা প্রতিমা প্রায় ৫০ কেজি পাটের আঁশ দিয়ে মোড়ানো হয়েছে। পাটের আঁশের সূক্ষ্ম টানাটানা আঁচড়ও প্রতিমাজুড়ে বিদ্যমান ও দৃশ্যমান হয়েছে। অনেক আগেই এই পূজামণ্ডপে প্রতিমা তৈরি ও রঙের কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। প্রতিমার রঙেও পাটের আঁশের চিরায়ত রং স্থান পেয়েছে। কলারোয়া পৌরসভাধীন উত্তর মুরারিকাটি পালপাড়া সর্বজনীন পূজামণ্ডপের এই ব্যতিক্রমী সৃজনকর্ম সচক্ষে দেখতে প্রতিদিনই ভিড় জমাচ্ছেন দর্শনার্থীরা। দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক, অসুর, মহিষাসুরসহ সবকটি প্রতিমা মোড়ানো হয়েছে পাটের আঁশে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গিয়ে দেখা যায়, মোট ১২টি প্রতিমা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি প্রতিমার গায়ে সোনালি ঝলক। জানা গেছে, পাটের আঁশ ছোটো ছোটো টুকরো করে চিরুনি দিয়ে মসৃণ করা হয়েছে। এরপর মাটির প্রতিমার গায়ে একে একে বসানো হয়েছে আঁশ। রং ব্যবহার প্রায় হয়নি বললেই চলে, পাটের প্রাকৃতিক আভাতে দ্যুতি ছড়াচ্ছে এই পুজামণ্ডপজুড়ে।
নতুনধারায় এ শিল্পকর্ম ইতোমধ্যে মুগ্ধতা এনে দিয়েছে ভক্তবৃন্দের মধ্যে। পাটের আঁশের মোড়কে গড়া এই প্রতিমায় দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকেও তুলে ধরা হয়েছে। পালপাড়া পূজামণ্ডপ কমিটির সাধারণ সম্পাদক পলাশ পাল জানান, প্রায় ৫০ কেজি পাটের আঁশ দিয়ে গড়া এ প্রতিমায় ৪ জন ভাস্কর টানা ৩ মাস পরিশ্রম করেছেন। মূল প্রতিমাশিল্পী প্রহ্লাদ বিশ্বাস পরম মমতায় এটি তৈরি করেছেন। খুলনার কপিলমুনির এই গুণী ভাস্কর ও প্রতিমাশিল্পী আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে পাটের আঁশের রঙে রাঙিয়ে দিয়েছেন সবগুলো প্রতিমা। শনিবার পালপাড়া মণ্ডপে যেয়ে দেখা যায়, দর্শনার্থীরা ভিড় করে নতুন আঙ্গিকে গড়া এই প্রতিমা দর্শন করছেন। মহিলাদের মধ্যে কেউ কেউ বিগ্রহের সামনে এসে প্রণাম জানাচ্ছেন। পূজামণ্ডপের সাথে যুক্ত থাকা শিক্ষক প্রদীপ কুমার পাল বলেন, গত বছর ব্যতিক্রমী কিছু করতে না পারায় এবছর নতুন কিছু করে দেখানোর জন্য পূজামণ্ডপের দায়িত্বশীলরা আলোচনা করে এই পাটের আঁশের মোড়কে প্রতিমা নির্মাণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেন। আড়াই মাসের বিরামহীন প্রচেষ্টায় ও প্রতিমাশিল্পী-ভাস্করের অনুপম কারুকার্যে অবশেষে সম্ভব হয়েছে নতুন কিছু করে দেখানোর সেই পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন। তিনি বলেন, কলারোয়া উপজেলার মধ্যে আমরাই পেরেছি নতুন কিছু করে দেখাতে। সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সহযোগিতায় এটি সম্ভব হয়েছে বলে শিক্ষক প্রদীপ পাল মনে করেন। রীনা রানী পাল ও তাপস পাল নামের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা জানান, অন্য এলাকার অনেকেই নতুনধারার ব্যতিক্রমী এই প্রতিমা দর্শনে এখানে আসছেন।
মণ্ডপের আর এক দায়িত্বশীল কাজল পাল তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, চিনিগুঁড়া ধানের গড়া প্রতিমা দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও সুখ্যাতি পেয়েছিলো। আমাদের বিশ্বাস, পাটের আঁশ দিয়ে গড়া এই প্রতিমাও সবখানেই দ্যুতি ছড়াবে। পালপাড়া পূজামণ্ডপ কমিটির নেতৃবৃন্দের মতে, পাট দিয়ে প্রতিমা তৈরি শুধু ব্যতিক্রম ও নতুনধারা নয় বরং কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের শিকড় ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরার এটি একটি প্রয়াস। উল্লেখ্য, এবছর কলারোয়া উপজেলায় ৪৫ টি পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজা উদযাপিত হচ্ছে। এরমধ্যে উত্তর মুরারিকাটি পালপাড়া পূজামণ্ডপে বিশেষভাবে গড়া পাটের আঁশের মোড়কের এই প্রতিমা সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নজর কেড়েছে বহুমাত্রায়।