
বিশেষ প্রতিবেদক, তালা:
সফলতা ব্যর্থতার সহযাত্রী। ঢেউ যত বড়ই হোক না কেন আছড়ে পড়া ঢেউ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নামই হলো সফলতা। এমনি এক অপ্রতিরুদ্ধ জীবন যুদ্ধে হার না মানা যুবক সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার ধলবাড়িয়া গ্রামের প্রতিবন্ধী হাবিবুর রহমান (২৯)। ধলবাড়িয়া গ্রামের বজলুর রহমানের ৩ পুত্র ও ৩ কন্যার মধ্য হাবিবুর রহমান হলেন ছোটভাই। প্রায় বছর ৬ আগে জীবনের তাড়নায় ভাটায় কাজ করতে করতে উতপ্ত বালিতে হাবিবুরের পায়ের তলার চামড়া নষ্ট হয়।
সেখান হতে ধীরে ধীরে পচন ধরতে শুরু করে পায়ের অধিকাংশ স্থান। বহু ডাক্তার কবিরাজ দেখান তার সহয় সম্বল বিক্রয় করে। তবে তাতে কোন সুরহা না হওয়ায় ৫ বছর আগে স্থানীয়দের সহযোগিতায় সাতক্ষীরা নিরাময় ক্লিনিকে ডা: হাফিজউল্লাহ অপরেশন করেন। অপারেশনে তার ডান পায়ের হাটুর উপরের অংশ কেটে ফেলতে হয়। হয়ে যান প্রতিবন্ধী, কর্ম করার ক্ষমতা হারালেও হাবিবুর বেছে নেননি ভিক্ষা বৃত্তি। তৈরী করেছেন একটি ভাসমান চায়ের দোকন। সেটাও ক্ষণস্থায়ী হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
পুরো সংসার প্রতিবন্ধী হাবিবুরের উপর নির্ভর। বছর ৯ আগে বিবাহ হলেও তাদের পরিবারের আছেন ৭ বছরের একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান। বর্তমানে তাদের ৩ জনের একটি সুখি সংসার। তবে সুখি সংসার হলেও অভাবে তাড়না অনেক সময় তাদের না খেয়ে দিনাতিপাত করতে হয়। গড়ে তুলেছেন সাতক্ষীরা-খুলনা মহাসড়কের পাশে নওয়াপাড়া নামক স্থানে ভাসমান চায়ের দোকন। বেচা কেনা তেমন ভালো না হলেও স্থানীয় যুবকদের কাছে মামার কফি খুব জনপ্রিয়।
তবে সম্প্রতি সেই ভাসমান দোকানটি হতে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সংসার পরিচালনা করা হয়ে উঠেছে দুর্বিসহ। সব মিলিয়ে আশে পাশে কোন দায় দেনা না করে লড়ে যাচ্ছেন জীবন সংগ্রামে। হাটা চলা ঠিকমতো করতে না পারার সত্বেও সুদূর খলিষখালী হতে কষ্ট করে নিয়ে আসেন চা কফির তৈরীর উপকরণ খাটি গরুর দুধ। কফির দামও কম মাত্র ২০ টাকা।
পাশের দোকানদার প্রশংসা করে বলেন হাবিবুর একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও মানুষ হিসেবে সৎ ও নিষ্ঠাবান। সংসারের হাল নিজেই ধরে রেখেছেন সে। অভাব-অনাটন থাকলে অন্যর কাছে হাত পাতেন না হাবিবুর। সামান্য অর্থ উর্পাজন করে হাবিবুর সংসার পরিচালনা করে আসছেন। তবে আমাদের এই স্থানে লোকজন খুবই কম আসেন। আবার চায়ের দোকানও আনুপাতিক হারে বেশি। তার পরে হাবিবুর প্রতিবন্ধী । তাই দোকানে লোকজন খুবই কম প্রবেশ করে।
প্রতিবন্ধী হাবিবুরের স্ত্রী নাছিমা বেগম জানান, আমাদের বিবাহের প্রায় ৩ বছরের মাথায় স্বামী হাবিবুরের ডান পায়ের একটি অংশ বিচ্ছন্ন করতে হয়। সেই থেকে অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছি। ভাসমান দোকান করে কোন মতে সংসার পরিচালনা করার চেষ্টা করলেও দোকানে ক্রেতা কম আসায় সংসারের ঘানি টানতে কষ্ট হয় হাবিবুরের।
স্থানীয় যুবক শেখ তাজোয়ার, অন্তু দাশ, উৎস, ফারদিন, আকাশ, মেহেদী ইমরান জানান, হাবিবুর মামার চা কফি খুবই জনপ্রিয় হলেও আমাদের এলাকা হতে অনেক দূরে হওয়ার কারনে সেখানে যেতে কষ্টকর হয়ে যায়।কফির দাম অন্য দোকানের তুলনায় খুবই কম নেন। তবে মামার দোকানটি যদি ভাসমান না হয়ে স্থায়ী একটি জায়গা পেতো তাহলে ভালো হতো। আমারা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি যে মামার কফির দোকানটির জন্য একটি স্থায়ী দোকান করার জায়গা নির্ধারণ করে দেওয়া হোক।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আলাউদ্দীন জানান, ধলবাড়িয়ার হাবিবুর ভাটায় কাজ করতে গিয়ে পায়ের তলার চামড়া নষ্ট হয় যায়। আমি এবং স্থানীয় ব্যক্তিদের সহযোগিতায় তার অপরেশন সম্পন্ন করিয়ে আনি। তাকে একটি প্রতিবন্ধী কার্ড করে দিয়েছি। তা হতে অর্থ পান খুবই সামান্য। যা দিয়ে তাদের সংসার চলে না। তবুও হাবিবুর ভিক্ষা বৃত্তির পথ না বেছে নিয়ে একটি ভাসমান দোকান করেছেন। যদি তার একটি স্থায়ী দোকান হতো তাহলে তার পরিবারটি খেয়ে পরে বাচতে পারতো। আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে জোর দাবি করছি যাহাতে তাকে একটি স্থায়ী দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়।
সরজমিনে প্রতিবন্ধী হাবিবুরের দোকানে এ প্রতিবেদক সন্ধ্যা আনুমানিক ৭ টার দিকে গিয়ে দেখেন অন্য আশে পাশের অন্য সকল চায়ের দোকানে সামান্য ভীড় হলেও হাবিবুরের দোকানে প্রায় জনশূন্য অবস্থা। কথপোকথনে হাবিবুর আক্ষেপ করে বলেন, অনেক কষ্টে আছি সংসার চালাতে পারছি না। আপনারা তো সাংবাদিক দেখেন আমার জন্য কিছু করতে পারেন কিনা। দিলেন এক কাপ কফি। দাম দিতে গেলেও নিতে অস্বীকার করেন হাবিবুর। বলেন মামা আরেক কাপ কফি দেই। প্রতিবেদক আতœসম্মানে দিকে তাকিয়ে এবং কফির দাম না নেওয়ার কারণে অগ্যতা নানা অজুহাত দেখিয়ে দোকান হতে প্রস্থান করেন।
প্রতিবন্ধী হাবিবুর রহমান জানান, ছোটবেলা থেকে এমনটা ছিল না। পারিবারিক অভাবের কারণে পড়াশুনাও করতে পারিনি। পড়াশুনা করেছি মাত্র ৫ম ক্লাস পর্যন্ত। প্রায় ৫ বছর আগে এক দুর্ঘটনায় আমার পঙ্গত্ববরণ করতে হয়। সংসারে অভাবের কারণে উন্নত চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি। করতে পারলে হয়তো সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব হতো। কিন্তু সংসার চালাব না উন্নত চিকিৎসা করব। ‘আমার বড়লোক হবার স্বপ্ন নয়, স্ত্রী সন্তানের মুখে দুই বেলা দু’মুঠো খাবার তুলে দেওয়া আমার একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। একটি ভাসমান দোকান করেছি তবে দোকানটি তেমন চলে না।
আর অর্থের অভাবে ভালো কোন দোকান করতে পারছি না। কোন এনজিও কাছে লোন চাইলেও প্রকিবন্ধী হওয়ার কারনে লোন দিতে অস্বীকার করেন। যদি উপজেলার প্রাণ কেন্দ্র তালা উপ-শহরের কাঁচা বাজারে সরকারী খাস সম্পর্ত্তিতে একটি দোকান ঘর বরাদ্দ পেতাম তাহলে কোন রকমে দিনাতিপাত করতে পারতাম। আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমির কাছে আকুল আবেদন করছি আমাকে একটি সরকারী জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হোক।