২৭’শ টাকায় চলছে চার মাস
আহাদুর রহমান: নভেম্বরের শেষে শনাক্ত হওয়া ও ডিসেম্বর থেকে বিস্তার লাভ করা কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসে বিশ্বব্যাপী ত্রাহি অবস্থা। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্য মানুষেরা হয়েছে চরম অসহায়। এই পরিস্থিতিতে ভাল নেই সাতক্ষীরা জেলা জজ আদালতের জুনিয়র আইনজীবী ও আইনজীবী সহকারীরা। টানা চারমাস মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা। সীমিত আকারে আদালত চললেও সবার ভাগ্যের সিঁকে ছিড়ছেনা।
সাতক্ষীরা জেলা জজ আদালতে কর্মরত আছেন প্রায় ২০০ জন জুনিয়র আইনজীবী ও সাড়ে চার’শরও বেশি আইনজীবী সহকারী। চলমান কোভিড-১৯ সংকটে ২৫শে মার্চ থেকে দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে ধাপে ধাপে আদালতে কিছু নির্দেশনা জারি করা হয়। সে মোতাবেক ভার্চুয়াল আদালত চললেও জুনিয়র আইনজীবীরা স্মার্ট ফোনের অভাবে আদালতে যোগ দিতে পারছেন না। বেশ কিছুদিন আদালত বন্ধ থাকায় টান পড়ে জমিয়ে রাখা সঞ্চয়ে। এ পরিস্থিতিতে স্মার্ট ফোন কেনাও তাদের দ্বারা সম্ভব নয়। ফলে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা। অনেক আইনজীবী সহকারি সাময়িক অন্য পেশায় আছেন। কারও অবস্থা এতটাই খারাপ যে সংসার খরচ চালানোর জন্য স্ত্রী বাধ্য হয়ে গৃহপরিচারিকার কাজও নিয়েছেন। এর মধ্যে সহায়তা বলতে জুনিয়র আইনজীবিরা পেয়েছেন কেন্দ্রীয় বার কাউন্সিলের পাঠানো বার’শ টাকা ও জেলা আইনজীবী সমিতির রিলিফ ফান্ডের পনের’শ টাকা। আর আইনজীবী সহকারিরা পেয়েছেন সরকারের খাদ্য সহায়তা। তাও সবাই পাননি। এ অবস্থায় নাভিশ্বাস উঠেছে তাদের। সঞ্চয়ের সব টাকাই সংসার চালাতে খরচ হয়ে গেছে।
সাতক্ষীরা জেলা জজ আদালতের আইনজীবী সুনীল বলেন, আমরা কোর্ট করেছি মার্চ মাসের ২৪ তারিখে। এরপর থেকে করোনা ভাইরাসের কারনে আদালত ২/৩ মাস বন্ধ ছিল। পরে হইকোর্ট থেকে ভার্চুয়াল কোর্টের নির্দেশনা আসে। এখন ভার্চুয়াল কোর্ট করতে গেলে ভাল স্মার্ট ফোন লাগবে। এ ধরনের ফোনের দাম কমপক্ষে ৮-১০ হাজার টাকা। কিন্তু জুনিয়র আইনজীবীদের ১০ হাজার টাকা খরচ করে এ ধরনের ফোন কেনার সক্ষমতা নেই। এ ছাড়াও সংক্রমনের ভয়ে বাইরে না যাওয়ায় অনেকেই ভুগছেন অর্থ সংকটে। সব মিলিয়ে আমরা জুনিয়ররা দূর্বিসহ জীবন যাপন করছি।
তিনি আরও বলেন, ভার্চুয়াল কোর্ট হল যারা হাজতে থাকবে তাদের জন্য। আবার হাজতি আসামী খুব বেশি না। সিভিল আদালতও বন্ধ। এখানে ভার্চুয়াল কোর্ট শুধুমাত্র হাজতি আসামীদের জন্য আর কিছু না। তবে প্রায় বিশদিন আগে নির্দেশ আসল ওয়ারেন্টের আসামী আত্মসমর্পন করতে পারবে। তবে একসাথে ৪জনের বেশি না। আর স্বাস্থ্য বিধি মেনে এজলাশের ভিতর ৫ জনের বেশি আইনজীবী ঢুকতে পারবেনা। প্রর্তেক দিন ৪-৫টার বেশি মামলার শুনানী হবে না। এখন অবশ্য বিভিন্ন মামলার ফাইলিং হচ্ছে। কিন্তু বিচারিক মামলা, টিআর মামলা এইগুলো হচ্ছে না। যা জুনিয়রদের আয়ের জায়গা।
[caption id="attachment_24581" align="alignright" width="374"] বঙ্গবন্ধু পেশাজীবি পরিষদের কোর্ট শাখার সভাপতি ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক মনোরঞ্জন বন্ধোপধ্যায় (বাঁয়ে), জেলা জজ আদালতের আইনজীবী সুনীল (ডানে)।[/caption]
এক প্রশ্নের জবাববে তিনি বলেন, ঢাকা বার থেকে আইনজীবী মাথা পিছু ১২’শ টাকা আসছিলো। ১২’শ টাকায় তো কিছু হয় না। তিনি বলেন, আমাদের এই দুঃসময়ে সাতক্ষীরা বার একটি রিলিফ ফান্ড গঠন করেছিল। তা থেকে আইনজীবী পিছু ১৫’শ টাকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যারা পায়নি তাদের আর দেওয়া হবে না। ওই ফান্ড নাকি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন কোন আইনজীবী যদি ভুল বশতঃ নিতে না পারে তাহলে এই ফান্ড থেকে টাকা আর নিতে পারবে না। আমি নিজেও এই টাকা পাইনি। আমরা জুনিয়ররা ক্ষতিগ্রস্থ, নেই আমাদের ভার্চুয়াল কোর্ট করার জন্য স্মার্ট ফোন, নেই সাতক্ষীরা বারের সহানুভুতি।
আরেক জুনিয়র আইনজীবী শেখ মামুন ফিরোজ বলেন, ২৫শে মার্চ বন্ধের পর থেকে আমাদের অবস্থা সামগ্রীক ভাবে খুবই খারাপ। দুস্থদের নানা সুবিধা থাকলেও আমাদের মত এলিটদের দিকে কারও কোন নজর নেই। তিনি প্রধান বিচারপতির কাছে বিষয়টি দেখার জন্য আবেদন করে বলেন, আমাদের জন্য কমপক্ষে দুই বছরের নূন্যতম রেশন কার্ড চালুর ব্যবস্থা করলে উপকার হয়।
বঙ্গবন্ধু পেশাজীবি পরিষদের কোর্ট শাখার সভাপতি ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক মনোরঞ্জন বন্ধোপধ্যায় বলেন, আমরা জীবিকার তাগিদে আইনজীবী সহকারি হিসেবে আছি। ২৫শে মার্চ থেকে সাধারণ ছুটির পর থেকে আমরা খুব কষ্টে আছি। সীমিত আকারে অল্প কিছু খাদ্য সহায়তা আমরা পেয়েছি। তবে সবাই সেটা পাই নাই। জীবিকার তাগিদে ঘরের বাইরেতো আসতেই হবে। তাই স্বাস্থ্য বিধি মেনে আমরা কাজ করছি। কিন্তু কাজ হাতে বেশি না থাকায় কমবেশি সবাই মানবেতর জীবন যাপন করছি। তিনি দাবি করে বলেন, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে আদালতের সকল কার্যক্রম চালু করা হোক। এ ক্ষেত্রে শুধু বাদী-বিবাদীদের আইনজীবীরা আদালতে উপস্থিত থেকে আইন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন। তাহলে জুনিয়র আইনজীবী ও আইনজীবী সহকারিদের প্রকৃত সহায়তা হবে।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ্যাড. এম শাহ আলম জানান, করোনা সৃষ্ট পরিস্থিতিতে শুধু জুনিয়রই নয় যারা শুধুমাত্র আইনজীবী পেশায় নিয়োজিত সিনিয়র-জুনিয়র সবাই কষ্টে আছে। আগামী ৫ই অগাস্ট থেকে সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে যথারীতি আদালতের সকল কার্যক্রম পুনরায় চালু হবে।
এদিকে চার মাসের বেশি সময় বন্ধ থাকার পর, ঈদুল আযহার পরে বাংলাদেশের আদালতগুলো পুনরায় খুলে দেয়া হবে বলে বিবিসি’কে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
তিনি জানান, মাননীয় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আমার শেষ যে আলাপ হয়েছে, সেটা হচ্ছে ঈদের পরে স্বাভাবিক আদালতগুলো (নিম্ন আদালত) খুলে দেয়া হবে।''
তবে ফৌজদারি মামলার বিচারিক কাজে বা সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়ায় কিছু বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে বলে তিনি জানান। কিন্তু দেওয়ানি মামলায় সেটা নাও থাকতে পারে।
''কিন্তু অন্যান্য কাজের সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে, সাধারণ আদালতের যেভাবে কাজ হচ্ছিল, সেই ভাবেই হবে। সেটা ঈদের পরেপরেই খুলে দেয়া হবে।''