জি,এম আমিনুর রহমান, শ্যামনগর থেকে: বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের শেষ জেলা সাতক্ষীরা। যার অধিকাংশ উপজেলা উপকূলীয় অঞ্চল নিয়ে গঠিত। বিশেষ করে শ্যামনগর উপজেলা সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেষে অবস্থিত। এ কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বার বার বিধ্বস্ত হয় শ্যামনগরের জনপদ। প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ।
উপকূলে হিন্দু ,মুসলিম থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, জেলে, ঋষি সহ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর বসবাস। সিডর, আইলা, ফণী, নার্গিস, বুলবুল সহ একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিঃস্ব করেছে উপকূলের মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত মানুষকে। যারা এখন অতি দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে।
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে বিধ্বস্ত এ অঞ্চলের মানুষকে প্রতিনিয়ত বাস করতে হচ্ছে নদী ভাঙন সহ প্লাবন,জলোচ্ছাসের আতঙ্ক নিয়ে। তার উপর এবার মরার উপর খড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। সমগ্র বিশ্বে মহামারী আকারে দেখা দেয়া করোনার তাণ্ডব শ্যামনগর উপকূলে এখনো দেখা না দিলেও করোনা সংক্রমণ রোধে নিজেদের কাজ কর্ম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে বাড়িতে অবস্থান করে দিশেহারা হয়ে পড়েছে উপকূলের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ। দেখা দিয়েছে হাহাকার। যা অন্য সব দুর্যোগের চেয়ে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে তাদের জীবনে। সেই সাথে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ফেরা শ্রমিক শ্রেণিকে নিয়ে দানা বাঁধছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা।
এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ সুন্দরবন ও মৎস্য চাষের উপর নির্ভরশীল। করোনার বিপর্যয়ের কারণে মৎস্য চাষে নেমে এসেছে ভাটা। সুন্দরবনের প্রবেশে হয়ে দাড়িয়েছে বাঁধা। জেলেরা সুন্দরবনের প্রবেশ করে মাছ ধরে এনে বিক্রি করতে পারছে না। তাই অধিকাংশ জেলে পরিবারকে থাকতে হচ্ছে অর্ধহারে- অনাহারে।
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের ক্ষতি কাটাতে না কাটাতেই করোনাভাইরাস আমাদের জীবনকে শেষ করে দিচ্ছে- এরকমই অভিব্যক্তি ব্যক্ত করে গাবুরা ইউনিয়নের হতদরিদ্র জিন্নাত আলী জানান, তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন তিনি।
বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের এক মৎস্য ব্যবসায়ী বলেন, এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ঘের প্রসেস করে অনেক টাকা খরচ করেছি। করোনা ভাইরাসের কারণে ঘেরের মাছ বিক্রি করতে পারছি না। ঋণ পরিশোধের চিন্তাও চলে আসছে মাথায়। পরিবার পরিজন নিয়ে কিভাবে দিন কাটাবো ?
সুন্দরবনের মৌয়াল আব্দুর রউফ জানান, গতবছর এ সময় আমরা মধু বিক্রি করেছি অনেক চড়া দামে এবং মধু কেনার জন্য অনেক খরিদ্দার পাওয়া যেত। করোনা ভাইরাসের কারণে আমরা মধু বিক্রি করতে পারছি না, তাই পরিবার নিয়ে খুবই সমস্যার মধ্যে আছি।
হরিনগর বাজারের কাকড়া ব্যবসায়ী আফজাল মল্লিক জানান, করোনা ভাইরাস শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের কাকড়ার ব্যবসায় ভাটা নেমেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে ঘরে বসে আছি। আল্লাহ জানে কি হবে। খুব কষ্ট করে সময় পার করতে হচ্ছে।
মুন্সীগঞ্জে হোম কোয়ারেনটাইনে থাকা ভাটা শ্রমিক আলম বলেন, ৬ মাস ভাটায় কাজ করে বাড়ি এসে বসে আছি। দাদন নেয়া ছাড়া করোনা ভাইরাসের কারণে ভাটার সরদাররা বাকি টাকা দিচ্ছে না। ছেলেমেয়ে নিয়ে কষ্টে দিন কাটাতে হচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের রেশ শেষ কাটতে না কাটতেই করোনার প্রাদুর্ভাব উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষকে গভীর সংকটে ফেলেছে।
বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মন্ডল বলেন, প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকূলীয় অঞ্চলে হানা দেয়। ফলশ্রুতিতে এই অঞ্চলের মানুষ অতি দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। তারা হাজার চেষ্টা করেও ঘুরে দাড়াতে ব্যর্থ হয়। এরই মধ্যে আসে নতুন দুর্যোগ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তাদেরকে হিমশিম খেতে হয়। ঠিক তেমনি ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাব শেষ হতে না হতেই করোনার প্রাদুর্ভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ নিঃস্ব হতে বসেছে। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে এই ক্ষতি। সাধারণ মানুষকে ভুগতে হবে অনেকদিন। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য দারিদ্র্য হার অনুযায়ী বরাদ্দ দেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।