সাতনদী অনলাইন ডেস্ক: প্রবাসী শ্রমিক নিজাম উদ্দিন কোভিড-১৯ মহামারির কারণে গত বছরের মে মাসে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে আসেন। কয়েক মাস পর তার আবাসন অনুমতির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, যার অর্থ তিনি আর সেই উপসাগরীয় দেশটিতে ফিরে যেতে পারবেন না।
সৌদি আরবে তার মাসিক আয় প্রায় ৫০ হাজার টাকার মত ছিল, কিন্তু তাকে তার আয়ের সিংহভাগ দেশে পাঠিয়ে দিতে হতো, কারণ এই রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকতো তার সাত সদস্যের পরিবার।
পারিবারিক খরচ বহন করতে গিয়ে তার সামান্য সঞ্চয় শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে কারণে নোয়াখালী থেকে আসা ৪২ বছর বয়সী নিজাম ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন এবং সেই টাকা বিনিয়োগ করে তিনি তার এলাকায় একটি ছোট জুতার কারখানা স্থাপন করেন। কিন্তু কারখানাটি সাফল্যের মুখ দেখেনি। তিনি সেটিকে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।
নাজিম পরবর্তীতে কয়েক ধাপে তার আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে আরও প্রায় তিন লাখ টাকা ধার নিতে বাধ্য হন, কারণ তিনি এখনো কোনো চাকরি খুঁজে পাননি। এখন এই ঋণের দায় থেকে কীভাবে মুক্ত হবেন, সে দুশ্চিন্তায় তিনি প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
‘আমি জানি না আমার এখন কি করা উচিৎ’, বলেন তিনি।
নাজিমের মত অনেক ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিক মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সমস্যায় ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। খুবই সামান্য অথবা একেবারেই কোনো আয় না থাকার কারণে প্রত্যাগত প্রবাসী শ্রমিকরা খুবই হতাশাগ্রস্ত এবং তারা ঋণ পরিশোধ করতে ও তাদের গৃহস্থালি খরচ জোগাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।
সরকারি তথ্য বলছে, করোনা মহামারির কারণে প্রায় ৩ লাখ ৭৬ হাজার প্রবাসী শ্রমিক গত বছরের ১ এপ্রিল থেকে ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে ফিরে এসেছেন।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা প্রতিবেদনে প্রবাসী কর্মীদের ঋণের বোঝার পরিমাণ এবং সমাজে তাদের পুনরায় সংহতকরণের চ্যালেঞ্জগুলো দেখানো হয়েছে।
‘র্যাপিড এসেসমেন্ট রাউন্ড ২: নিডস অ্যান্ড ভালনারাবিলিটিস অব ইন্টারনাল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল মাইগ্রেন্টস ইন বাংলাদেশ’ নামের রিপোর্টটি থেকে জানা যায় যে, প্রত্যাগত ৮৭৫ জন প্রবাসী শ্রমিকের মধ্যে ৬৯ শতাংশ কর্মী এবং তাদের পরিবার ঋণগ্রস্ত।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, তাদের মধ্যে ২৮ শতাংশ কর্মীর ঋণের পরিমাণ দুই লাখ টাকার বেশি এবং ৫০ শতাংশেরও বেশি শ্রমিকের ঋণ এক লাখ টাকার বেশি।
গত বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে প্রত্যাগত প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি এরকম ১২টি জেলায় এই সমীক্ষাটি পরিচালিত হয়েছিল।
প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে যে, প্রত্যাগত প্রবাসী কর্মীদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ বর্তমানে বেকার।
‘ঋণের দায়ে দিশেহারা’
গত বছরের শুরুর দিকে কোভিড-১৯ মহামারি সারাবিশ্বে আঘাত হানার পর অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক দেশে ফিরে আসেন। তাদের অনেকেই চাকরি হারিয়েছিলেন অথবা সেসব দেশে চাকরির কোনো সুযোগ খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
কিন্তু বাংলাদেশে ফিরে এসেও তারা নিজেদের কাজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মানানসই চাকরি খুঁজে পেতে ঝামেলায় পড়ছেন।
আইওএম’র প্রতিবেদনে ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের পরিবারগুলোর একটি হতাশাজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়ায় তাদেরকে বিভিন্ন নেতিবাচক পন্থা অবলম্বন করে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হচ্ছে, যেমন চিকিৎসা বাবদ খরচ কমিয়ে দেওয়া এবং ঋণ পরিশোধের জন্য আরও টাকা ধার নেওয়া।
সোলায়মান মিয়া এমনই একজন প্রত্যাগত প্রবাসী শ্রমিক।
নোয়াখালীর সেনবাগ নিবাসী ৪৬ বছর বয়সী সোলায়মান বাহরাইন থেকে গত বছরের মার্চে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন। তার নিয়োগদাতা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাকে আবারও নিয়োগ দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
দেশের ফেরার কয়েক মাস পর থেকে তিনি বার বার তার বাহরাইনের নিয়োগদাতার সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছেন, কিন্তু নিয়োগদাতা তার ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন এবং তাকে আবারও চাকরি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। কারণ হিসেবে নিয়োগদাতা চলমান অর্থনৈতিক মন্দার কথা উল্লেখ করছেন।
নিরুপায় হয়ে তিনি তার আত্মীয়দের কাছ থেকে এক লাখ ৬০ হাজার ধার, ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ এবং এনজিও থেকে আরও ৩০ হাজার টাকা ঋণ নেন। এমনকি খরচ মেটানোর জন্য তিনি তার স্ত্রী ও মায়ের সোনার গয়নাও বিক্রি করতে বাধ্য হন।
অসহায় কণ্ঠে সোলায়মান বলেন, ‘ফিরে আসার পর থেকেই আমি বেকার। এখন ভাবছি ঋণ পরিশোধ করার জন্য এক টুকরো জমি বিক্রি করে দেব। এ ছাড়া, আমার আর কীইবা করার আছে, যেহেতু আমি ঋণে নিমজ্জিত’।
যদিও তিনি প্রায় ২০ বছর দেশের বাইরে ছিলেন, তবুও তিনি যথেষ্ট পরিমাণে টাকা জমাতে পারেননি। তার সমগ্র সঞ্চয় তিনি খরচ করেছেন পরিবারের দৈনন্দিন খরচ মেটাতে এবং একটি নতুন বাড়ি নির্মাণ করার কাজে।
মাসুদ মোল্লাহর অবস্থাও করুণ।
নরসিংদীর ৩২ বছর বয়সী মাসুদ এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে লিবিয়া থেকে ফিরে এসেছেন। তিনি জানিয়েছেন যে, ২০১৯ সালে তিনি অভিবাসনের খরচ জোগাড় করার জন্য প্রতিবেশীদের কাছ থেকে প্রায় ৮০ হাজার টাকা এবং একটি স্থানীয় সমবায় থেকে আরও ৬০ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন।
যদিও তিনি ৮০ হাজার টাকার ঋণটি পরিশোধ করতে পেরেছেন, তবুও তিনি ৬০ হাজার টাকার ঋণের বিপরীতে ১১টি কিস্তির মধ্যে ৫টি কিস্তির টাকা এখনো পরিশোধ করতে পারেননি।
‘আমার ভবিষ্যৎ খুবই অনিশ্চিত’, বলেন মাসুদ।
কী করণীয়?
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, মহামারির কারণে অভিবাসনের দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে অনেক প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
এ প্রবাসী শ্রমিকরা ঋণ নিয়ে অথবা তাদের সম্পত্তি বিক্রি করে অভিবাসনের খরচ যুগিয়েছেন এবং ফিরে আসার সময় তাদের অনেকেই ঋণগ্রস্ত ছিলেন, জানান শরিফুল।
দেশের ফিরে আসার পর পারিবারিক খরচ মেটানোর জন্য তাদেরকে আবারও নতুন করে ঋণ নিতে হয় অথবা টাকা ধার নিতে হয়, বলেন তিনি।
শরিফুল জানান যে, সরকারের উচিৎ বেকার থাকা প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য চাকরির সুযোগ তৈরি করা, যা তাদেরকে ঋণের দায় থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে।
প্রচুর পরিমাণে বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিক বিভিন্ন দেশে নির্মাণ সংস্থাগুলোতে কাজ করে দক্ষতা অর্জন করেন। সুতরাং, বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে তাদের জন্য কাজ করার সুযোগ তৈরি করা উচিৎ, বলেন তিনি।
একইভাবে, অন্যান্য খাতে দক্ষ প্রত্যাগত শ্রমিকদেরকেও দেশের ভেতর, তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাজের জন্য নিয়োগ দেওয়া উচিৎ। এ ছাড়াও, যারা আবারও বিদেশে ফিরে যেতে চান, তাদেরকেও সহায়তা করা উচিৎ, বলেন তিনি।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রশিক্ষণ অণুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. নাজীবুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় প্রত্যাগত প্রবাসী শ্রমিকদের আরপিএল (রিকগনিশন অব প্রায়র লার্নিং) বা অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি সনদ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে।
নাজীবুল এ সংবাদপত্রকে ফোনে জানিয়েছেন, আরপিএল সনদ পেলে একজন ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিক আভ্যন্তরীণ বাজারে চাকরি পেতে পারবেন এবং একইসঙ্গে এটি তাকে পুনরায় বিদেশে ফিরে যেতেও সাহায্য করতে পারবে।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান যে, তাদের প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে দুই হাজার প্রত্যাগত শ্রমিককে আরপিএল সনদ দেওয়া। তবে প্রবাসী শ্রমিকদের সাড়া দেওয়ার পরিমাণ অনুসারে এ সংখ্যা বাড়ানো হতে পারে, জানান তিনি।