জাতীয় ডেস্ক: নারায়ণগঞ্জের আবু বক্কর ওরফে রিয়াসাদ রাইয়ান বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় ২০২১ সালে শিক্ষক আল আমিনের মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হয় সে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১২ তরুণের সঙ্গে তথাকথিত হিজরত করে পাহাড়ে যায়। পরে নিজের ভুল বুঝতে পারে। ফেরার চেষ্টা ও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গেলে তা সম্ভব হয়নি। পালাতে গিয়ে দুইবার ধরা পড়ে নির্যাতনের শিকার হয়। সর্বশেষ গত মার্চের প্রথম দিকে আবু বক্করসহ বেশ কয়েকজন পালাতে সক্ষম হয়।
মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) রাতে র্যাব-১১ ব্যাটালিয়ন কার্যালয়ে আবু বক্করসহ চার তরুণ আত্মসমর্পণ করে। নিজেদের পরিচয় ও কথিত হিজরতের পর ভুল বোঝার তথ্য দিলে তাদের আটক করে র্যাব। ওই চার জন হলো–নারায়ণগঞ্জ বন্দরের আবু বক্কর ওরফে রিয়াসাদ রাইয়ান (১৬), সিলেট ওসমানী নগরের মো. হাসান সাইদ (২৬) ও শেখ আহমেদ মামুন (২৩) এবং মাদারীপুরের মো. ইয়াছিন (২১)। বুধবার (৯ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কাওরানবাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, গত বছরের ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে আট তরুণ নিখোঁজ হয়। পরে তাদের পরিবারের সদস্যরা কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। র্যাব নিখোঁজ তরুণদের উদ্ধারে গোয়েন্দা নজরদারি কার্যক্রম চালাতে গিয়ে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়া’ নামে একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের তথ্য পায়। র্যাব জানতে পারে, এই সংগঠনের সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফ’র (কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) সহায়তায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, পরে ২০২২ সালের অক্টোবরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালায় র্যাব। অভিযানে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাসহ সর্বমোট ৭৮ জন এবং পাহাড়ে অবস্থান, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কার্যক্রমে জঙ্গিদের সহায়তার জন্য কেএনএফ’র ১৭ নেতা ও সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। র্যাব ইতোমধ্যে সংগঠনটির আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ, দাওয়াতি শাখার প্রধান আব্দুল্লাহ মায়মুন, সামরিক শাখার প্রধান রনবীর ও উপ-প্রধান মানিক, অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান রাকিবসহ অন্যদের গ্রেফতার করেছে। তিনি বলেন, ২০২১ সালে ভুল একটা পথকে সঠিক মনে করে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন কেবিন ক্রু মা আম্বিয়া সুলতানা ওরফে এমিলি। তিনি নিজেই তার ছেলেকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে প্রশিক্ষণের জন্য পাহাড়ে পাঠিয়েছিলেন। পরে র্যাবের ডি-র্যাডিকালাইজেশনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন তিনি। ছেলেকে ফিরে পেতে গত ৯ নভেম্বর র্যাবের সহায়তা চেয়ে গণমাধ্যমের সামনে হাজির হন ওই নারী।
ওই চার তরুণ সম্পর্কে খন্দকার আল মঈন বলেন, ইতোপূর্বে প্রকাশিত নিখোঁজ ৫৫ তরুণের তালিকায় তাদের নাম দেখতে পায় র্যাব। পরে তাদের আটক করা হয়।
চার তরুণের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়া এবং তাদের ফিরে আসা সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, তারা বিভিন্ন সময় বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিতজনের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়াতে যোগ দেয়। সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যরা তাদের ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে তথাকথিত হিজরতের কথা বলে। এছাড়া চাকরি দেওয়ার প্রলোভনে তাদের পাহাড়ে যেতে আগ্রহী করা হয়।
তিনি বলেন, পাহাড়ে যাওয়ার পর কেএনএফ’র সহযোগিতায় সংগঠনটির সশস্ত্র প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য কার্যক্রম ও চিন্তাভাবনা দেখে ওই তরুণদের ভুল ভাঙে। আরও বেশ কিছু সদস্যসহ এই চার জন ফিরতে চাইলেও ফিরতে দেয়নি জামায়াতুল আনসারের সদস্যরা। বরং বন্দি রেখে তাদের নির্যাতন করা হতো। পালাতে গিয়ে দুইবার ধরা পড়ে নির্যাতনের শিকার হয় তারা। পাহাড়ে নিয়ে জোরপূর্বক রসদ পরিবহন, রান্না, প্রশিক্ষণের গর্ত করা, ঘর বানানোসহ বিভিন্ন কাজে বাধ্য করা হতো তাদের।
র্যাব জানায়, ২০২২ সালের জুন মাসে সিপ্পি পাহাড় থেকে পালিয়ে রনিপাড়া এসে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে যাওয়ার রাস্তা খোঁজার সময় কেএনএফ সদস্যদের কাছে ধরা পড়ে চার তরুণ। এ সময় জঙ্গি ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিয়ে তাদের বন্দি রেখে নির্যাতন করা হয়। পরে পাহাড়ে র্যাবের অভিযান শুরু হলে তারা পালানোর পথ খুঁজতে থাকে। সুযোগ বুঝে অন্য সদস্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গত মার্চে পলিয়ে সমতলে চলে আসে। পরে তারা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, আত্মসমর্পণ করা এবং ভুল বুঝতে পারা জঙ্গিদের র্যাবের আইনগত সহযোগিতা দেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা। পরিবারের উৎসাহে এবং আইনগত সহযোগিতা পাওয়ার আশায় র্যাব-১১ কার্যালয়ে আত্মসমর্পণ করে ওই চার তরুণ। হাসান সাঈদ সম্পর্কে তিনি বলেন, সিলেট ওসমানী নগরের স্থানীয় মাদ্রাসা থেকে দাওরা হাদিস সম্পন্ন করা হাসান সাঈদ ২০২১ সালে শুরা সদস্য মায়মুনের মাধ্যমে উগ্রবাদে জড়ায়। ২০২১ সালের নভেম্বরে শুরা সদস্য রাকিবের মাধ্যমে পাহাড়ে যায়। পরে অন্য তরুণদের মতো ভুল ভাঙে তার। দুবার পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে নির্যাতনের শিকার হয় সে।
শেখ আহমেদ মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সে সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রকৌশল বিষয়ে অধ্যয়নরত ছিল। ২০২১ সালে সাঈদের মাধ্যমে জামায়াতুল আনসারে যোগ দেয়। ২০২১ সালের নভেম্বরে সাঈদসহ বেশ কয়েকজন তরুণের সঙ্গে পাহাড়ে যায়।
ইয়াসিন ছিল মাদারীপুরের একটি দোকানের ঘড়ি মেকানিক। সিরাজের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে ২০২১ সালের নভেম্বরে পাহাড়ে যায়। পার্বত্য অঞ্চলে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কার্যক্রম দেখে সে ভুল বুঝতে পারে এবং সমতলে ফিরে আসে।
কেএনএফ ও নতুন জঙ্গি সংগঠনের পরিত্যক্ত একটি ক্যাম্প থেকে দুই জঙ্গি সদস্যের লাশ উদ্ধার সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, পাহাড়ে তিনটি ট্রেনিং সেন্টার ছিল কেএনএফ’র। এই তিনটি ক্যাম্পের একটি থেকে হোমিও চিকিৎসক ডাক্তার আহমেদ ও রাইয়ানের গৃহশিক্ষক আল আমিনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই চার তরুণ আলাদা ক্যাম্পে থাকায় সরাসরি হত্যা দেখেনি। তবে তারা অন্য সদস্যদের মাধ্যমে জেনেছে, বিভিন্ন সময় কেএনএফ’র সঙ্গে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংঘর্ষ হতো। আবার নিজেরাও সংঘর্ষে জড়িয়ে যেতো। প্রশিক্ষণরত জঙ্গি সদস্যদের সামনে রেখে সংঘর্ষ হতো। এমনই এক সংঘর্ষে ডাক্তার আহমেদ মারা যায়। আর আল আমিনের মৃত্যু সম্পর্কে তারা জেনেছে, প্রশিক্ষণের সময়ে বিভিন্ন নির্যাতন, না খাইয়ে রাখা, তাদের দিয়ে অমানবিক কাজ করানো হতো। যেমন- প্রশিক্ষণের জন্য গর্ত তৈরি ও খাল কাটার কাজ তাদের দিয়ে করানো হতো। আল আমিন প্রশিক্ষণরত অবস্থায় মারা যেতে পারে বলে তারা জানায়।
তিনি বলেন, ওই চার তরুণ স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করলেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। তাদের ফিরে আসার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আদালত নিশ্চয়ই সুবিচার করবেন। এ ক্ষেত্রে র্যাবের পক্ষ থেকে আইনি সহায়তা দেওয়া হবে।
র্যাব জানায়, নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসারে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘর ছাড়া ৫৫ তরুণের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। এরমধ্যে ৪৮ জন আত্মসমর্পণসহ আটক হয়েছে। তবে এখনও নিখোঁজ রয়েছে সাত জন। তাদের আইনের আওতায় আনার তৎপরতা চলছে।