বিভিন্ন অনিয়ম ও দূর্নীতি পর্ব- ৯
হাবিবুর রহমান/ শেখ আব্দুল হাকিম, শ্যামনগর থেকে: শ্যামনগর উপজেলা হিসাবরক্ষণ ও এলজিইডি অফিসের খরচের দোহাই দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে শিক্ষা অফিসার আক্তারুজ্জামান মিলনের বিরুদ্ধে ৭৪ লক্ষ ৯৭ হাজার ৪ শত ৫০ টাকা ঘুষ বানিজ্যের অভিযোগ উঠেছে।
শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, শ্যামনগর উপজেলায় ১২ টি ইউনিয়নে ১৯১ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে এসব বিদ্যালয়ে উন্নয়ন খাতে ১১ টি প্রকল্পে বরাদ্দ আসে ৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। প্রকল্প গুলো হলো, পিইডিপি-৪ মাইনর মেরামত, ঘূর্ণীঝড় আম্ফান, বিদ্যালয়ে ¯øীপ খাত, রক্ষনাবেক্ষন খাত,প্রাক প্রাথমিক খাত, ক্ষুদ্র মেরামত খাত, খেলা-ধুলা সামগ্রী খাত, অস্থায়ী গৃহ র্নিমান খাত, এডুকেশন ইন এমারজেন্সি খাত, ওয়্যাশবøক খাত ও রাজস্ব মেরামত খাত।
শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনা ছিলো ৩০ জুনের মধ্যে বিদ্যালয় গুলোর মেরামত ও সংস্কারের কাজ শেষ করে ১০ জুলাই (২০২০) এর মধ্যে ব্যয়িত অর্থের হিসাব প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে প্রদান করার কথা ছিল। সে মোতাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিস নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বরাদ্দের ব্যয়িত অর্থের হিসাব প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে প্রদান করেছেন। তবে শিক্ষা অফিসারের গাফিলতিতে বিদ্যালয় গুলোতে কোন কাজ শেষ হয়নি। বরাদ্দকৃত প্রকল্পের টাকা সরকারি রাজকোষে ফিরে যাওয়ার শঙ্কায় উপজেলা শিক্ষা অফিসার কৌশলে এলজিইডি অফিস থেকে কাজ শেষ হয়েছে মর্মে প্রত্যয়ন ও বরাদ্দকৃত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের নিকট থেকে কাজ সম্পন্ন হওয়ার রেজুলেশন ও ভাউচার সংগ্রহ করেন। কিন্তু অধিকাংশ স্কুলের সভাপতিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের স্বাক্ষর জাল করে প্রধান শিক্ষকরা রেজুলেশন শিক্ষা অফিসে জমা দিয়েছেন।
এদিকে উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসার ইয়াছিন আলী (অঃদঃ) কে নগত নারায়নে তুষ্ঠ করে ২৯ জুন ১১টি প্রকল্পের বরাদ্দের ৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা উত্তোলন করে শিক্ষা অফিসার নিজ একাউন্টে নিয়ে আসেন বলে শতাধিক প্রধান শিক্ষকরা এই প্রতিবেদককে জানান।
আর ৫৮টি স্কুলে পিইডিপি-৪ মাইনর মেরামত, ১৬ টি স্কুলে ক্ষুদ্র মেরামত, ৩টি বিদ্যালয় অস্থায়ী গৃহ নির্মান, ৩টি বিদ্যালয়ে এডুকেশন ইন এমারজেন্সি মেরামত,১টি বিদ্যালয়ে রাজস্ব মেরামত, ঘূর্ণীঝড় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্থ ৪২ টি স্কুল মেরামত। সরকারি নিদের্শনা আছে এসব বরাদ্দ কৃত স্কুলের মেরামত খাতে কাজের পূর্বে সংশ্লিষ্ট এলজিইডি অফিস থেকে প্রাককলন নিয়েই কাজ শুরু করতে হবে। আর কাজ শেষ হলে সরেজমিনে কাজ দেখে এলজিইডি অফিসের প্রকৌশলীরা শিক্ষা অফিসে চুড়ান্ত ভাবে প্রত্যায়ন দিবেন। আর শিক্ষা অফিসার প্রত্যয়ন পেয়ে তবেই স্ব-স্ব স্কুলে বরাদ্দের চেক প্রদান করবেন। কিন্তু এখানে হয়েছে তার উল্টোটা। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও তা উপেক্ষা করে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে এলজিইডি অফিস প্রকৌশলীরা সরেজমিনে কাজ না দেখে মনগড়া কাল্পনিক প্রত্যয়ন দিয়েছেন বলে জানা গেছে। অভিযোগ আছে, শিক্ষা অফিসারের যোগসাজসে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এলজিইডি অফিস প্রকৌশলীরা ম্যানেজ হয়ে এমন নিয়ম বর্হিভূত অপকর্মে লিপ্ত হয়েছেন।
শিক্ষকরা বলেন, এলজিইডি অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট স্কুলগুলোতে প্রাককলন দেওয়া হয়নি। আর বরাদ্দের টাকার চেক ছাড় পেতে শিক্ষা অফিসারদের খাত অনুযায়ী ১০% থেকে ১৫% এমনকি ২৬% হারে নগদ টাকা দিতে হয়েছে।শিক্ষকরা দাবী করেন শিক্ষা অফিসার হিসাবরক্ষণ অফিসে ভ্যাট কর্তন পূর্বক বরাদ্দের সমুদয় টাকা নিজ একাউন্টে জমা রাখেন। যাহা একাউন্ট চেক করলে উল্লেখিত অনিয়মের প্রমান মিলবে। শিক্ষা অফিসার ইচ্ছা মতো বরাদ্দের চেক প্রদানের সময়ে নগদ টাকা না দেওয়া পর্যন্ত বরাদ্দের চেক ছাড় পারছেন না শিক্ষকরা। অভিযোগ আছে, বহু স্কুল এখনো পর্যন্ত বরাদ্দের চেক পাইনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শ্যামনগর উপজেলা শিক্ষা অফিসার আক্তারুজ্জামান মিলনের আহবানে শিক্ষা অফিসে ২ জুন জরুরী এক আলোচনা সভা ডাকেন। ওই সভায় সহকারী চার শিক্ষা অফিসার মোঃ শাহ্ আলম, আজহারুল ইসলাম, সোহাগ হোসেন, সোহাগ আলম এবং শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের পাঁচ নেতা সহ ১২ টি ইউনিয়ন শিক্ষক সচিব উপস্থিত ছিলেন। ৬২ নং আটুলিয়া আদর্শ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি দীনেশ চন্দ্র মন্ডল, ১২০ নং দক্ষিন ছোট কুপট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম (হেলাল), ১৬০ নং শিশু শিক্ষা নিকেতন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষক পরিষদের সভাপতি পরিমল কর্মকার, ১২২ নং গাবুরা খোলপেটুয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দেলওয়ার হোসেন ও ১৫৭ নং ফুলবাড়ি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহ সভাপতি গনেশ চন্দ্র সাহা। আরো উপস্থিত ছিলেন, শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি আব্দুল্যাহ আল মামুন সহ অন্যান্য নেতা গোছের শিক্ষকরা।
এ সময় শিক্ষা অফিসার আলোচনা সভায় বলেন,দেশে করোনার কারণে এবছর স্কুলের বরাদ্দ খুবই সীমিত। শিক্ষা অফিসার নাটকীয় কৌশলের আশ্রয় নিয়ে উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিস ও উপজেলার প্রকৌশলী (এলজিইডি) অফিসের খরচ তোলার বাহানা করেন। আলোচনা সভায় উপস্থিত শিক্ষক নেতাদের সর্ব সম্মতি ক্রমে বরাদ্দকৃত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের কাছ থেকে ¯িøপ খাতে ২ হাজার টাকা ও অন্যান্য খাত অনুযায়ী ১০% থেকে ১৫% এমনকি ২৬% হারে নগদ টাকা তোলার বিষয়টি সভায় গৃহীত হয়। শিক্ষক গোছের নেতারা ও ১২ জন প্রধান শিক্ষক (সচিবরা) জানান,বরাদ্দ সীমিত হওয়ার কথা বলায় শিক্ষা অফিসারের প্রস্তাবে আমরা রাজি হয়ে ছিলাম। কিন্তু শিক্ষা অধিদপ্তর হতে বরাদ্দ বেশি আসার কথা জানলে আমরা কখনো টাকা তোলায় রাজি হতাম না। শিক্ষা অফিসার বরাদ্দ গোপন রেখে কৌশলে সচিবদের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষকদের নিকট থেকে হিসাবরক্ষণ ও এলজিইডি অফিসের খরচের দোহাই দিয়ে ৬৩ লক্ষ ৯ হাজার ৪ শত ৫০ টাকা ঘুষ বানিজ্য করেছেন।
এছাড়া ভ্যাট খাতে শিক্ষা অফিসার আরো অতিরিক্ত দূর্নীতি করেছেন ১১ লক্ষ ৮৮ হাজার টাকা।
উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসার ইয়াছিন আলী (অঃ দঃ) সাথে মুঠো ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ২৯ শে জুন প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের ১১ টি প্রকল্পের বরাদ্দকৃত টাকার ভ্যাট কর্তন করার পর সমুদয় টাকা উপজেলা শিক্ষা অফিসারের একাউন্টে নিয়ে নেয়। তবে তিনি ঘুষ নেওয়ার বিষয় অস্বীকার করেন।
উপজেলা এলজিইডি অফিসের সহকারী প্রকৌশলী মোঃ শামীম ও সহিদুল ইসলাম বলেন, ৩০ শে জুনের মধ্যে বিদ্যালয়ের কাজ শেষ না হওয়ায় বরাদ্দের টাকা সরকারি রাজকোষে ফিরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এর পরি প্রেক্ষিতে শিক্ষা অফিসার আক্তারুজ্জামান মিলন এবিষয়ে আমাদের সাথে আলোচনায় বসেন। কিন্তু শর্ত সাপেক্ষে মানবিক দৃষ্টি কোন থেকে আমরা প্রাথমিক ভাবে কিছু প্রত্যয়ন দেই। তবে কথা ছিলো কাজ দেখে চুড়ান্ত প্রত্যয়ন না দেওয়া পর্যন্ত বরাদ্দকৃত বিদ্যালয় গুলোকে চেক ছাড় করতে পারবেন না। কিন্তু শিক্ষা অফিসার আমাদের না জানিয়ে নিজের ক্ষমতা বলে চেক ছাড় করেছেন। তবে ঘুষ নিয়ে প্রত্যয়ন দেওয়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
এ বিয়য়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসার আবÍারুজ্জামার মিলন বলেন, জুনের ২ তারিখে আমার অফিসে শিক্ষক সমিতির নেতাদের নিয়ে আলোচনায় বসে ছিলাম ঠিকই। সচিবদের মাধ্যমে স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের নিকট থেকে নগদ টাকা তোলার বিষয় তিনি অস্বীকার করে বলেন আমার অফিসের সহকারী অফিসাররা ভালো জানেন।
শ্যামনগরে জাতীয় পার্টির সিনিয়র সভাপতি এ্যাড, আজিবর রহমান বলেন, শিক্ষা অফিসার আক্তারুজ্জামান মিলনের দূর্নীতির খবরটি এখন সর্বত্র আলোচিত। এটি খুবই লজ্জাজনক ব্যপার। তিনি আরো বলেন, এসব শিক্ষা অফিসারের দূর্নীতির কারণে দেশের শিক্ষার মান ব্যপক ক্ষুন্ন হচ্ছে। এবিষয়ে শিক্ষা অধিদপ্তরের জরুরী ভিত্তিতে তদন্ত র্পূবক আইনানুগ ব্যবন্থা সহ দূর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন।