
নিজস্ব প্রতিবেদক: আশাশুনির শ্রীউলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু হেনা সাকিলের বিরুদ্ধে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্ধকৃত ত্রাণ বিতরনে নানা অনিয়ম- দুর্নিতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করেছে স্থানীয়রা। ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শনে গত রবিবার সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক ইউনিয়নের মহিষকুড় বাজারে গেলে সেখানে তার কাছে উক্ত অভিযোগ করেন ইউনিয়নবাসী। এ সময় জেলা প্রসাসক সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চান এবং যেকোন মূল্যে ক্ষতিগ্রস্ত সবার কাছে ত্রানসামগ্রী পৌছে দেয়ার জন্য নির্দেশনা দেন। এতে জেলা প্রশসকের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেন উপস্থিত এলাকাবাসী।
জানা গেছে, বিগত ২০ মে ঘুর্ণিঝত আম্ফানে এবং পরবর্তীতে গত ১৮ আগস্ট থেকে নদীর পানি স্বাভাবিক জোয়ারের থেকে কমপক্ষে ৩/৪ ফুট বেশী উঁচু হয়ে রিং বাঁধ ভেঙ্গে গোটা শ্রীউলা ইউনিয়ন প্লাবিত হয়। নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ও প্রচুর বৃষ্টিপাতের প্রভাবে রিং বাঁধ ভেঙ্গে শ্রীউলা ইউনিয়নের (সম্পূর্ণ) ২২টি গ্রামের ৩৬ সহ¯্রাাধিক মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছে। এলাকার খাদ্য, সুপেয় পানি, স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। ইউনিয়নের মানুষ বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র, স্কুল, বাড়ির ছাদ, রাস্তার উপর পলিথিন দিয়ে ছেয়ে বসবাস করছেন। অনেকে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। পুরো এলাকার সড়ক ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। খাদ্য সংকট ও সুপেয় পানির অভাব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। পশু পাখির বসবাস ও খাদ্য যোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কাচা ঘরবাড়ি ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়া ও বিদ্যুত না থাকায় যোগাযোগের অভাবে মানুষ বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাসের মত বসবাস করছে। ৩ মাস আগে আম্ফানের তান্ডবে ইউনিয়নটির বেড়ীবাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে মানুষ ঘরবাড়ি, মৎস্য ঘের, ফসল, সহায় সম্পদ হারিয়ে করুন পরিণতির সাথে যুদ্ধ করে কোন রকমে বেঁচে অছে।
প্লাবিত ও ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার চিত্র পরিদর্শনে ও ত্রাণ বিতরনে গত রবিবার (৩০আগস্ট) সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস, এম মোস্তফা কামাল শ্রীউলা ইউনিয়নের মহিষকুড় বাজারে যান। সেখানে স্থানীয় জনগণ ও কয়েকজন ইউপি সদস্য জেলা প্রশাসকের কাছে স্থানীয় চেয়ারম্যান আবু হেনা শাকিলের বিরুদ্ধে দুর্যোগকালীন সময়ে ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি চিত্র তুলে ধরেন।
এ সময় উপস্থিত এক ইউপি সদস্য জেলা প্রশাসকের উদ্দেশ্যে বলেন ইউপি সদস্য হওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত তিনি কোনো ত্রাণ বা সরকারি অনুদান বিতরনের তালিকা প্রস্তুত করতে পারেননি বা করতে দেয়া হয়নি।
এ সময় জেলা প্রশাসক ঘটনাস্থলে উপস্থিত চেয়ারম্যান আবু হেনা শাকিলের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যখন আমাকে তালিকা করার নির্দেশ দেন তখন এক দিনের মধ্যে তালিকা প্রস্তুত করে জমা দেয়ার কথা বলেন। অভিযোগকারী ইউপি সদস্যর কাছে তালিকা প্রস্তুত করার কাজ দিলে তিনি সেটি সময় নিয়ে প্রস্তুত করেন বিধায় আমি অন্যের মাধ্যমে তালিকা প্রস্তুত করে সেটি জমা দেই।
জেলা প্রশাসকের কাছে চেয়ারম্যানের দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা তুলে ধরার সময় ধারণকৃত ভিডিওতে দেখা গেছে, একজন ইউপি সদস্যা বলছেন, চেয়ারম্যান আবু হেনা হাকিল স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে সরকারি অনুদান বিতরণ করতে গিয়ে ইউনিয়নের আওয়ামী পরিবারগুলোকে বাদ দিয়ে জামায়াত-বিএনপির লোকদেরকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে তালিকা প্রস্তুত করে চলেছেন। এ সময় ত্রাণ বঞ্চিত এলাকাবাসী জেলা প্রশাসকে জানান, ধর্না দিয়েও সরকারি ত্রাণ সামগ্রী পাচ্ছি না অথচ যারা ঘুমিয়ে থাকে তাদের ঘুম থেকে ডেকে উঠিয়ে ত্রাণ দিচ্ছে চেয়ারম্যান।
জানা গেছে, বাঁধ ভাঙ্গার পর ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাবাসীর জন্য সরকারি বেসরকারিভাবে ইতোমধ্যে চাউল, আটা, নগদ টাকা, শুকনা খাবার, ঔষদ সামগ্রী, ঈদ সামগ্রী ও নৌকা সহ নানা সাহায্য সহযোগিতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এসব সহযোগিতা বিতরনে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি করেছেন বলে অভিযোগ করেছে স্থানীয়রা।
অভিযোগকারীদের মধ্যে মহিষকুড় গ্রামের স্বামী পরিত্যাক্তা রেবেকা খাতুন বলেন, আমি এখানকার ভোটার,স্বামীহারা হয়ে ১০/১২ বছর যাবৎ এখানে অনেক কষ্টে বসবাস করছি। নিজের অস্বচ্ছলতার কথা বহুবার চেয়ারম্যান সাহেবকে বলেছি। কিন্তু তিনি আমাকে কিছুই দেননি। অথচ অনেক স্বচ্ছল ব্যক্তিদেরকে তিনি বিভিন্নরকম সহযোগিতা দিয়েছেন। তিনি বলেন বন্যায় ডুবে যাওয়ার পর অন্য একটি মাধ্যমে ত্রানের তালিকায় নাম উঠাই কিন্তু গত রবিবার আমি ডিসি স্যারের কাছে অভিযোগ করায় ডিসি স্যার চলে যাওয়ার পর ঐ তালিকা থেকে চেয়ারম্যান আমার নাম কেটে দিয়েছে।
মহিষকুড় গ্রামের নাজমুল ইসলাম(৫৫) বলেন চৌকিদারের কাছে অনেকবার ভাটার আইডি কার্ড দিয়েছি কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন ত্রাণ সহায়তা পাইনি।
একইগ্রামের এলাহি বক্স গাজী (৬৫) বলেন, শুধু ভিটেটুকু ছাড়া আমার আর কিছুই নেই কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আজ পর্যন্ত কোন সহায়তা পাইনি। অথচ আমার থেকে অনেক স্বচ্ছল ব্যক্তি যারা ছেয়ারম্যানের নিজের লোক তাদেরকে চেয়ারম্যান ত্রাণ দিয়েছেন।
মহিষকুড় গ্রামের রফিকুল ইসলাম গাজী (৬২) বলেন, আমার এক শতাংশ জমিও নেই, গত ঈদেও সময় সরকার ১০ কেজি কওে চাউল দিয়েছে। কিন্তু চেয়ারম্যানের পরিষদ থেকে আমাকে ৭ কেজি চাউল দেয়া হয়েছে। এই ৭ কেজি চাউল ছাড়া আজ পর্যন্ত আমি আর কোন ত্রাণ পাইনি।
মহিষকুড় গ্রামের মোজাফ্ফার মোড়ল (৬৫), খোকন মোল্যা (৪৫), ইউনুছ আলী মোড়ল, ইদ্রিস আলী, মেজবাহ উদ্দীন ম্যোল্যা সহ স্থানীয় আর অনেকে অভিযোগ করে বলেন এই ওয়ার্ডে বিশেষ করে মহিষকুড় গ্রামে চেয়ারম্যান কোন সহায়তা/ ত্রাণ সামগ্রী দেননা। আমরা গরীব, অসহায়, ক্ষতিগ্রস্থ, বানভাসী হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের রেষারেষি আর রাজনীতির কারনে চেয়ারম্যান আমাদের কোন কিছুই দেননা। আমরা কিছুই পাইনি।
এ ব্যাপারে শ্রীউলা ইউনিয়ন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও ৭,৮,৯ নং সংরক্ষিত ওয়ার্ডেও ইউপি সদস্য মজিদা খানম অভিযোগ করে বলেন, আমি ১৫ বছর মেম্বর। বর্তমান চেয়াম্যানের আমলেও আমি এখন ইউপি সদস্যা হওয়া সত্ত্বেও চেয়ারম্যান সাকিল সাহেব আমাকে পরিষদের কোন কাজে অংশ গ্রহন করতে দেননা। তিনি আমার এউ তিন ওয়ার্ডেও মানুষের জন্য আমার মাধ্যমে কোন সরকারি সহডোগিতা/ ত্রাণ সামগ্রী দেন না। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে আমার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছেন। এমনকি সরকার প্রদত্ত আমার সম্মানি ভাতাও তিনি আমাকে দেননা। শুধু আমাকেই নয়, তার অনিয়মের নীরব দর্শক না হওয়ায় আরও ২/৩জন মেম্বরকেও তিনি তাদেও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত কওে রেখেছেন। তিনি আরও বলেন, চেয়ারম্যান বানবাসী মানুষের জন্য সমভাবে কিছুই বন্টন করেননি। সবকিছুতেই তিনি ইউনিয়ন পরিষদের বাইরের নিজের লোক দ্বারা কাজ করেন।
তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত আমি কিছুই পাইনি, গত রবিবার এলাকাবাসীর পাশাপাশি আমিও ডিসি স্যারকে আমার অভিযোগের কথা বলেছি, তৎক্ষনাৎ ডিসি স্যার চেয়ারম্যানের কাছে এর কারন জিজ্ঞাসা করলে চেয়ারম্যান ঐদিনই তা দিতে চেয়েছিলেন কিন্ত ডিসি স্যার চলে গেলে এখনো পর্যন্ত আমাকে আমার ওয়ার্ডবাসীর জন্য কিছুই দেয়া হয়নি।
শ্রীউলা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাতি মুকুল হোসেন বলেন, যারা চেয়ারম্যানের অনুসারী না তারা যতো গরীবই হোক না কেন তারা ইউনিয়ন পরিষদের সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। নিজের মত পথের না হওয়ায় চেয়ারম্যান প্রকৃত অসহায় দুঃস্থ ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে তার নিজের লোকদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী সহ বিভিন্ন সরকারি সহযোগিতা বিতরণ করে থাকেন। গত ঈদেও সময়ও যে চাউল বিতরণ করা হয়েছে তাতে ১০ কেজির পরিবর্তে ৬কেজি, ৭কেজি, সাড়ে সাত কেজি করে বিতরণ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে শ্রীউলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নূর মোহাম্ম্দ সরদার বলেন, ১৯৯৭৭ সাল থেকে আমি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি, বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলেও শ্রীউলা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ সহ এর অঙ্গ সংগঠনের নেতা কর্মীরা সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ইউপি চেয়ারম্যান সাকিল দলীয় নেতা কর্মীদের সাথে কোন কিছু সমন্বয় করেন না। তিনি জামায়াত বিএনপি’র লোকদের নিয়ে চলেন এবং তাদেরকেই সকল সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদেরকে তিনি কোন সহযোগিতা দেননি। বিভিন্ন সরকারি সহযোগিতা/ ত্রাণ বিতরণে তিনি নানারকম অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি করে থাকেন।
এ ব্যাপারে শ্রীউলা ইউপি চেয়ারম্যান আবু হেনা সাকিলের বক্তব্য জানার জন্য তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে জেলা প্রসাসকের সামনে তার বিরুদ্ধে এলাকাবাসী অভিযোগ করার সময় তিনি বলেন, অভিযোগকারীদের অভিযোগ সঠিক নয়। শ্রীউলা ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তির তুলনায় বরাদ্ধকৃত ত্রানের পরিমান খুবই কম। এ পর্যন্ত যা কিছু সহযোগিতা পাওয়া গেছে তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অপেকক্ষাকৃত গরীব দুস্থদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ইউনিয়নের সকলকে সহযোগিতা প্রদান করা হবে বলে।
এ ব্যাপারে গত রবিবার বিকালে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেন, আপনারা কেউ ত্রাণের আওতা থেকে বাদ যাবেন না। পর্যায়ক্রমে যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তারাই আগে ত্রাণ পাবেন। জেলা প্রশাসক ইউপি চেয়ারম্যান অবু হেনা সাকিলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, কার মাধ্যমে কিভাবে করবেন সেটা আমার জানার বিষয় নয় তবে আমি দেখতে চাই ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার সবাই ত্রানের আওতায় এসেছে।