
হাবিবুর রহমান, দাদপুর (আশাশুনি) থেকে ফিরে :
ছিনতাইয়ের চক্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাবলুর রহমান নামের এক মার্কেট মালিককে ইয়াবা দিয়ে আটক করে বর্বর নির্যাতন চালানোর ঘটনা ঘটেছে। শুধু নির্যাতন নয় দেড় লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় বাবলুকে ইয়াবা ব্যাবসায়ী বানিয়ে মামলা দেওয়া হয়েছে। ঘটনাটি আশাশুনি উপজেলার কুল্যা ইউনিয়নের দাঁদপুর গ্রামের। ২৩ অক্টোবর ঘটে এ অমানবিক ঘটনা।
সরেজমিনে তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, দাঁদপুর গ্রামের ইনছার আলীর পুত্র বাবলু (৩৫) পৈত্তিক ভিটায় মার্কেট বানিয়েছে। মার্কেটে ১০টি দোকানঘর ভাড়া দেওয়া। ওই মার্কেটে সে সাইকেল সারাই এবং চায়ের ব্যবসা করে। ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় চায়ের দোকান থেকে বাবলু বের হয়ে যাচ্ছিল ওজু করতে। নামাজের উদ্দেশ্যে বের হওয়া বাবলুকে ধরে ফেলে এসআই বিজন। ধরে তাকে নেওয়া হয় তারই মার্কেটের ভাড়াটিয়া আমিরুলের দোকানে। আমিরুল ডেকোটের ও কম্পিউটারের ব্যবসায়ী। আমিরুলের দোকানে থাকা আমিরুলসহ তিনজনকে বের করে দেয় দারোগা বিজন। এরপর নিজের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটে থাকা ৩০ পিচ ইয়াবা নিচে ফেলে দিয়ে বাবলুকে বলা হয়, তুমিতো ইয়াবা ব্যবসায়ী। এ সময় কোন কাকুতি মিনতিও কাজে আসেনি বাবলুর। পরে তাকে নেয়া হয় গুনাকরকাটি ব্রিজের লাগোয়া শ্মশানঘাটার সামনের রাস্তায় ফাঁকা জায়গায়। সেখানে নিয়ে হাতে হ্যা-কাপ পরিয়ে, পা ও চোখঁ বেঁধে নির্দয়ভাবে নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতন চালায় দারোগা বিজন, এএসআই দেবাশীষ ও কন্সটেবল সোহান। এখনও তার শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন স্পষ্ট। নির্যাতন শেষে বলা হয়, দেড় লক্ষ টাকা দিলে ছেড়ে দেওয়া হবে নতুবা ইয়াবা মামলায় চালান দেওয়া হবে। দাবীকৃত ঘুষের টাকা দিতে না পারায় তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ওসির জিজ্ঞাসাবাদে বাবলু প্রকৃত ঘটনা খুলে বলে। এ সময় ওসি দারোগা বিজনকে ডেকে বকাঝকা করে এবং বলে, ঘটনাতো সঠিক নয়। পরে থানার মধ্যেও বাবলুকে লাঠিপেটা করা হয়। এসআই বিজন বাদী হয়ে বাবলুকে আসামী করে ৩০ পিচ ইয়াবা উদ্ধার মামলা দায়ের করে। প্রস্তুতকৃত জব্দ তালিকায় আমিরুল ও শিমুলকে স্বাক্ষী করা হলেও তারা ঘটনা উল্টো জানে। অর্থাৎ পুলিশ নিজেদের পকেটে থাকা ইয়াবা দিয়ে বাবলুকে ফাঁসিয়েছে। এমন অভিযোগ আমিরুল ও শিমুলের।
সাতনদীর সঙ্গে আলাপকালে দারোগা বিজন আমিরুলের দোকান থেকে ইয়াবাসহ বাবলুকে আটক করার কথা জানালেও মামলার এজহারের বর্ননা উল্টো। সেখানে বলা হয়েছে, রাস্তায় বাবলু ইয়াবা বিক্রি করছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঘটনাস্থলে গেলে বাবলু দৌড় মেরে গাছের গোড়ায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে পড়ে যায়। তাকে ধরে দেহতল্লাশী করলে লুঙ্গির কোসরে ৩০ পিস ইয়াবা পাওয়া যায়।
এ মামলায় এক মাসেরও অধিক মাস হাজতবাস করে বাবলু এখন অজানা আতঙ্কে। ইয়াবা ব্যবসায়ী বানানোর পর তার ওপর নতুন আবার কি বিপদ নেমে আসে এ নিয়েই আতঙ্কিত বাবলু। বর্ণিত ঘটনা নিয়ে কথা হয় কুল্যা ইউনিয়নের ০৮ নং ওয়ার্ডের মেম্বর আব্দুর রশিদের সাথে। তিনি বলেন, বাবলু নিছক একজন ব্যবসায়ী। সে মাদক ব্যবসায়ী হলে এলাকাবাসী জানতো।
কুল্যা ইউনিয়ন আওযামী লীগের সহ সভাপতি ও মহাজনপুর গ্রামের আব্দুল খালেক (৫০) মহাজনপুর সহকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দাউদ আলী (৫৫) দাঁদপুর গ্রামের মৃত. জিয়াদ আলীর পুত্র জাহিদ হাসান (২০), ডেকোরেটর ব্যবসাীয় আমিরুল, একই গ্রামের আব্দুস সালামের পুত্র শিমুল (২২), ৮ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলীসহ শতাধিক গ্রামবাসীর প্রশ্ন বাবলুকে কেন ইয়াবা ব্যবসায়ী বানানো হলো। সে তো খেটে খায়। তাকে কেউ খারাপ বলতে পারবে না।
তাদের সোজা সাপটা কথা বাবলুকে মাদক ব্যবসায়ী বানানোর নেপথ্যে ঘটনা খুুঁজে বের করতে হবে। মিথ্যা মামলা থেকে বাবলুকে অব্যাহতি দিতে হবে। দায়ী পুলিশ কর্মকর্তােেদর বিরুদ্ধে নিতে হবে কঠোর ব্যবস্থা।
বাবলু জানিয়েছে, তার মার্কেটে মাঝে মধ্যে আশাশুনি থানার দারোগা পুলিশ বসে। সে চা বিস্কুট পানি দিয়ে তাদের আপ্যায়নও করে সৌজন্যমূলকভাবে। এই আপ্যায়নই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় একাধিক ছিনতাইকারী সিন্ডিকেট সন্দেহ করে বাবলু এলাকায় পুলিশ নিয়ে আসছে এবং এজন্য তাদের হয়রানিও হতে হবে। এ আশংকা থেকে স্থানীয় সিন্ডিকেটের নেতা সালাম পুলিশকে ম্যানেজ করে তাকে মিথ্যা ইয়াবা ব্যবসায়ী বানিয়েছে।
বাবলু আরও জানায়, ঘটনার সময় আমার কাছে থাকা একটি স্যামফোনি মোবাইল ছিল। মোবাইলে ০১৯১৬৭০৬০৩৭, ০১৮৭৭৮৯০৩৯০ এই দুটি নম্বর ছিল। ঘটনার সময় মোবাইলটি আমার কাছ থেকে নেয় এসআই বিজন। তবে এখন চাইলে মোবাইলটি নেয়নি বলে জানিয়েছে। মারপিটকালে মোবাইলে পুলিশ ভিডিও করে বলে, তুই ইয়াবা ব্যবসা করিস স্বীকার কর আর ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নাম বল। না হলে তোর রক্ষা নেই। সে সময় আমি বলেছিলাম, আমাকে গুলি করে মারলেও বলবো না আমি ইয়াবার ব্যবসা করি। কেননা আমি তো ইয়াবার ব্যবসা করি না।
ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, বাবলুর দোকানে দারোগা পুলিশ মাঝে মধ্যে এসে বসার কারণে ক্ষিপ্ত ছিল স্থানীয় চৌকিদার পলাশ। এই পলাশও পুলিশকে ভুলতথ্য দিয়ে নিরীহ বাবলুকে ইয়াবা দিতে ফাঁসাতে সহায়তা করে।
কুল্যা ইউনিয়ন পরিষদের সকল সদস্য ও ইউপি চেয়ারম্যান বাবলুকে প্রত্যয়নপত্র দিয়েছে। তারাও এ ঘটনায় প্রতিকার চান। এ ব্যাপারে বাবলু পুলিশ সুপারের মাধ্যমে ঘটনার প্রতিকার প্রার্থনা করে মিথ্যা মামলা থেকে অব্যাহতি কামনা করেছেন।
ঘটনার বিষয়ে ব্যাপারে আশাশুনি থানার এসআই বিজন জানান, এসআই দেবাশীষ ও কনস্টেবল সোহানকে নিয়ে দাঁদপুর এলাকায় অভিযান চালানো হয়। পরবর্তীতে সোর্স মারফত খোঁজ পেয়ে ৩০ পিচ ইয়াবাসহ বাবলুকে আটক করা হয়। আটকের পর মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়। দেড় লাখ টাকা ও নির্যাতন চালানোর বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
এসআই বিজনের দাবি, বাবলু স্বীকার করেছে সে কুল্যার বাবলুর রহমানের কাছ থেকে ইয়াবা কিনেছে। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় তবে মামলার এজহারে ওই বাবলুর রহমানের নাম নেই কেন ?
এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী বাবলুর উদ্ধৃতি দিয়ে আশাশুনি থানার ওসিকে ঘটনার বিবরণ জানালে তিনি বলেন, যদি ঘটনাটি সাজানো হয় তবে সেটি খুব দুঃখজনক। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
নিউজের ভিডিও দেখতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
https://www.youtube.com/watch?v=YCy9R8fmO0A