মো. কামাল উদ্দিন:
আলোকিত মানুষ চলে গেলেন আলোহীন ঘরে, যে ঘর হতে আর কখনো তিনি ফিরে আসবেননা। তিনি গত ১৪ মে ২০২০ইং তারিখে ঢাকা সিএমএইচ’এ চিকিৎসাধিন অবস্থায় আমাদের কাছ থেকে চির বিদায় নেন। উনার মৃত্যুতে পুরোদেশ এবং জাতি শোকাহত হয়েছে। উনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের আকাশের উজ্জল নক্ষত্র। তিনি এমন একটি সময়ে আমাদের কাছ থেকে চলে গেলেন পুরো বিশ্ব তথা বাংলাদেশ যখন মরণব্যাধি করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের মাধ্যমে লাশের মিছিলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তখনই এই বাঙালি জাতি তথা বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যের বাতিঘর সেই করোনার ভয়াল থাবায় চলে যেতে বাধ্য হলেন। বাঙালি জাতি যুগ যুগান্তরে অনেক আরাধনার পর কিছু বিশেষ মানুষের সাক্ষাত পেলেও তাদেরকে কোননা কোন সময় হারাতে হয়। যেমন হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালি মহাকালের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের মুক্তি দিশারী হয়ে ১৯২০ সালে ১৭ই মার্চে গোপালগঞ্জে টুঙ্গি পাড়া জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি। দেশের সেনাবাহিনীর বিপদগামী ভাইরাস কিছু সংখ্যক দুর্বিত্ত্য সেনা কর্মীদের হাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট কালো রাতে স্বপরিবারে প্রাণ হারাতে হয়েছিল। আজ বাঙালি জাতির বাতিঘর জাতির জনকের জন্মশত বর্ষ চলাকালিন আমাদের কাছ থেকে জাতির জনকের আদর্শের প্রেরীত পুরুষ ড. আনিসুজ্জামান স্যার আমাদের কাছ থেকে চলে গেলেন। তিনি যে সময় বিদায় নিয়েছেন তখন মুসলমানদের পবিত্র রমজান মাস সেই পবিত্র রমজানের পবিত্রতায় উনার পরকালের জীবন একালের জীবনের চেয়েও আলোকিত বেশি হবে আমার বিশ্বাস। তিনি হয়ত আলোহিন কবরে আলোকবর্তিকা পেতে পারে মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ হতে। তার মৃত্যু আমাদেরকে নতুনভাবে ভাবনার জগতে ধাবিত করেছে। আনিসুজ্জামান আমাদের কাছ থেকে শারিরকভাবে বিদায় নিলেও ব্যক্তি আনিসুজ্জামান দেশ এবং জাতি তথা বাংলা সাহিত্যের জগতে আজীবন বেঁচে থাকবে। দেশবরণ্য শিক্ষাবিদ মননশীল প্রবন্ধকার হিসেবে আনিসুজ্জামান বাংলা সাহিত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত। সাহিত্যপাঠের সঙ্গে সমাজ চিন্তার যোগ তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য। তা পঠন পাঠনের পরিধি ব্যাপক। লেখবার বিষয় বিচিত্র। জীবন সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি উদার মানুষের মৈত্রী ও কল্যাণ তাঁর বৈশিষ্ট্য। তাঁর মধ্যে একদিকে আছে প্রাঞ্জলতা, অন্যদিকে যুক্তিতর্ক। একজন সমালোচক লিখেছেনÑ সারল্যের সাঙ্গ তারল্যের যে সম্পর্ক নেই তার প্রমাণ দিয়েছে আনিসুজ্জামানের রচনা। তাঁর প্রবন্ধে মুদ্রিত আছে প্রাবন্ধিক যুক্তি, মনন শৃঙ্খলা, সুনীতি ও সুগভীর ভাবনাশীলতা। আমাদের সংস্কৃতি জগতের অনেককে নিয়ে নানা সময়ে লেখা ২৮ টি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। ড. আনিসুজ্জামান স্যারের একাধিক বই আমি পড়েছি- সবচেয়ে আমার ভালো লেগেছে “পূর্বগামী” এ বইটি লেখকের প্রতিনিধিত্বমূলক রচনার সংগ্রহ। এতে যেমন আছে পাদটীকা কণ্টকিত দীর্ঘ ও গুর”তর আলোচনা, তেমনি আছে হালকা চালের লেখা মুখোমুখি আলাপের রচনা। এ বইয়ে আলোচিত ব্যক্তিদের অনেকের সম্পর্কেও কিছু নতুন আলোকপাত রক্ষিত। আনিসুজ্জামানের জন্ম ১৯৩৭ সালের কলকাতায় তবে ম্যাট্রিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত লেখাপড়া ঢাকায়। ১৯৫৬ সালে বাংলায় বিএ অনার্স পাস করেন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক পেয়ে। পরের বছরে এম এ তে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। ১৯৬২ তে পিএইচডি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমিক স্টাফ ফেলো ছিলেন এবং জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-প্রকল্পের সঙ্গে পাঁচ বছর জড়িত থেকেছেন। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার ১৯৮৫ তারপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। গবেষণার জন্য ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য ১৯৫৮ সালে রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক লাভ। মুক্তিযুদ্ধে তিনি বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন।
ঢাকা থেকে প্রকাশিতগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্যে মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র। মুনীর চৌধুরী, স্বরূপের সন্ধানে। পুরোনো বাংলা গদ্য, আমার চোখে, তাছাড়া, .... এই দেশ বরেণ্য শিক্ষাবিদ জ্ঞানতাপস দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ড. আনিসুজ্জামান স্যারের কাছ থেকে পাঠ্যশিক্ষা গ্রহণ করার ভাগ্য আমার হয় নি। আমি কিন্তু স্যারের একাধিক বই পড়েছি যে বইগুলোর লেখার পর্যালোচনা করার ক্ষমতা আমার নেই। উনার একেকটি বই একেকটি জ্ঞানসাগর। যে সাগরে সাঁতার দিয়ে আমার মত অল্পজ্ঞানের মানুষ কূল কিনারা পাব না। স্যারকে খুবই কাছে পেয়ে গেলাম গত ১৭ এপ্রিল দৈনিক আজাদী ভবনে। অকালে ঝরে যাওয়া ফুল বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মরহুম চৌধুরী জহুর”ল হকের গ্রন্থ প্রকাশনা উৎসবে।
স্যারের সাথে অল্প সময়ের আলাপচারিতায় অনেক কিছু বুঝে নিলাম। মনে মনে বললাম আনিসুজ্জামান কোন সাধারণ মানুষ নয়। উনি একজন বিশেষ মানুষ উনি হলেন দেশের সম্পদ, দেশের গর্ব এবং জাতির রতœ। শিক্ষাবিস্তারের পথরক্ষক আলোকিত মানুষ যার আলোয় আমরা সবাই আলোকিত হচ্ছি। সেই আলোর কথা আমার ক্ষুদ্র লেখনিতে লেখে শেষ করা যাবে না। পরিশেষে উনার আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা ও রূহের মাগফিরাত কামনা করে স্যারের প্রতি শ্রদ্ধাভরে অতিসামান্য লেখা লেখলাম।
লেখক: সাংবাদিক, উপস্থাপক ও মহাসচিব, চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম।