
আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের এক বছর পরও এটি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নিজস্ব মস্তিস্কপ্রসূত যুদ্ধ কিনা তা নিয়ে এখনো বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। কিয়েভে হামলার পর যুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের মধ্যে যাদের অনেকেই বাইরের দেশগুলোতে আশ্রয় চেয়েছিলেন; তারা সম্পূর্ণভাবে এই যুদ্ধের জন্য পুতিনকে দোষারোপ করেন। এই যুদ্ধের সমাপ্তি ও পরে অন্যান্য দেশের সঙ্গে মস্কোর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক মেরামত নিয়েও চিন্তিত অনেকে।
নির্বাসিত ও কারাগারে থাকা পুতিনের বিরোধী দলের নেতারা জোর দিয়ে বলেছেন যে, পুতিন পরবর্তী সময়ে এই পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে। পুতিন যখন ক্ষমতায় থাকবেন না তখন প্রতিবেশী এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে।
কারাবন্দি পুতিনবিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনি পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, যুদ্ধ সমাপ্তির পর পশ্চিমের উচিত হবে ইউক্রেনের পুনর্গঠনের জন্য ‘একটি মার্শাল পরিকল্পনা’ প্রস্তাব করা, তবে সেটি শুধু ইউক্রেনের জন্য নয়; সেটি রাশিয়ার জন্য প্রযোজ্য করা উচিত।
এ ছাড়া রাশিয়ার বিরোধীদলীয় নেতারা আশা করেন, পুতিনের জমানা শেষে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পুনরায় সেতুবন্ধ স্থাপন করবে মস্কো।
তবে ৭০ বছর বয়সি পুতিনের উত্তরসূরি হিসেবে কে আসতে পারেন তা নিয়েও জল্পনা রয়েছে। হতে পারে সেটি পশ্চিমাপন্থি বিরোধী দল বা ক্রেমলিনের বর্তমান দখলদারের কেউ। এ বিষয়ে কিছু নাম পণ্ডিতরা অনুমান করেছেন— রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান নিকোলে পাত্রুশেভ যদি আসেন, তবে তিনিও অন্তত পুতিনের মতোই ভীতু হবেন। সুতরাং ইউক্রেনীয়দের কাছে রাশিয়াকে পরাজিত হতে হবে, মস্কোর নেতৃত্বে যেই আসুক।
কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের কী হবে? এতদিন ধরে এত যত্নসহকারে সাজানো সম্পর্ক কি আগের অবস্থায় ফিরে আসবে?
এ ছাড়া পোল্যান্ড ও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি স্পর্শকাতর। কারণ গত বছর রাশিয়ান আগ্রাসন এবং ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের আগে তারা একটি অভিযোগ করেছিল যে, রাশিয়া পুনর্গঠনের নামে ইউরোপে হুমকি তৈরি করছে।
ফ্রান্স ও জার্মানি রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক বেশি অস্পষ্ট অবস্থায় ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইউরোপের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক এবং রাশিয়ার সঙ্গে কতটা সম্পর্ক গভীর করবেন তা নিয়ে তৎপর ছিলেন।
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের আগ পর্যন্ত ম্যাক্রো এ বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন এবং বিভিন্ন ধরনের কূটনৈতিক সমাধানের আশায় পুতিনকে ফোন করতেন। এর পর গত ডিসেম্বরে রাশিয়ার কাছে ‘নিরাপত্তা গ্যারান্টি’র কথা বলেছিলেন, যা তাদের মধ্যে নিষ্পত্তির একটি অংশ হওয়া উচিত।
এদিকে ইউক্রেনকে নিয়ে জার্মানি তার পূর্ব ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে আরও বেশি হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এটি নর্ডস্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইনের মতো ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক বিষয়ে দীর্ঘ বছর ধরে রাশিয়ানদের সঙ্গে গড়া সম্পর্ককে নষ্ট করছে। জার্মান রাজনৈতিক শ্রেণি দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়াকে বন্ধু হিসেবে দেখেছে এবং সাবেক চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোডারের মতো অনেকে মস্কোর রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে লাভজনক চুক্তিও করেছে।
তবে বিগত বছরগুলোতে তাদের কর্ম এবং নীতিতে কিছু পরিবর্তন এসেছে। ইউক্রেনে রুশ হামলার পরিপ্রেক্ষিতে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ ইউক্রেনকে সবদিক থেকে সহায়তা করছেন এবং সবসময় তাদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি জানিয়েছেন। তার অবস্থানের পক্ষে জার্মান জনগণেরও সমর্থন রয়েছে, যার অধিকাংশই ইউক্রেনপন্থি।
যাই হোক, জার্মানিদের মধ্যে একটি দ্বিমত রয়েছে এ বিষয়ে যে, তারা নিজেদের বৃহত্তর নিরাপত্তার জন্য রাশিয়ার প্রতি অধিক দুর্বল। তবে শলৎজ ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে বিশেষ করে লেপার্ড ট্যাংক সহায়তার মাধ্যমে তিনি এই ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে, জার্মান নেতৃত্ব পুরোপুরি মস্কোর ওপর ছেড়ে দেয়নি। জার্মানির যুক্তি হচ্ছে, রাশিয়া ততটুকুই আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে, যতটুকু আমরা তাকে করতে দেব।
তা হলে কি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন দীর্ঘমেয়াদে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে রাশিয়ার জন্য দরজা খোলা রেখে চলেছে?
না, ব্যাপারটা তেমন না। যুদ্ধ চলছে এবং এটি কখন থামবে তা বলা মুশকিল। তবে যতক্ষণ যুদ্ধ চলছে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ককে পুনরুজ্জীবিত করা ব্যতীত অন্য কোনো কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার কল্পনা করা কঠিন। বিশেষ করে পুতিন যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন, ততদিন সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
তবে যুদ্ধ সমাপ্তির পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ ও তার মিত্রদেশগুলো শুধু স্থিতিশীলতা রক্ষা করার জন্য এবং সম্পূর্ণ সম্মুখ সংঘর্ষ এড়াতে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করবে। তখন ১৯৯০ থেকে ২০০০ দশকের মতো পশ্চিমা নীতির সারমর্ম হবে নিয়ন্ত্রণ; একীকরণ নয়।
এই যুদ্ধ রাশিয়া ও ইইউয়ের মধ্যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এমন ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে, যা পুতিন পরবর্তী যে কেউ-ই আসুক তা পূরণ করা তার জন্য সহজ হবে না। রাশিয়া ছিল ইইউয়ের অন্যতম প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী; যার পরিপূরক কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ২০২১ সালে ইউরোপে রাশিয়ান গ্যাস আমদানির পরিমাণ ছিল ৫০ শতাংশ, যা বর্তমানে ১২.৯ শতাংশে নেমে এসেছে।
ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে চীন এবং দক্ষিণের অন্যান্য দেশের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। এটি হবে যুদ্ধের দীর্ঘস্থায়ী পরিণতির মধ্যে একটি।
তবে পুতিনবিরোধী রাশিয়ানরা আশা করেন যে, তাদের দেশ শেষ পর্যন্ত পশ্চিমে ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজে পাবে। এই যুদ্ধ যত তাড়াতাড়ি শেষ হবে, তত তাতাড়াড়িই ইউরোপীয় নেতারা তাদের পরবর্তী করণীয় নিয়ে ভাবার সুযোগ পাবে। তবু ইতিহাস বলে, যুদ্ধ হলো রূপান্তরকারী ঘটনা। ভালো হোক বা খারাপ হোক— ঘড়ির কাঁটা ২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারিতে আর ফিরে আসবে না।
*আলজাজিরায় কার্নেগি ইউরোপের ভিজিটিং স্কলার দিমিতার বেশেভের লেখা নিবন্ধ।