সিরাজুল ইসলাম শ্যামনগর: দেশের পট পরিবর্তনের পর থেকে এখন পর্যন্ত সুন্দরবনে বনদস্যুরা অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়তই জেলেদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে। মুক্তিপণ না দিতে পারলে জেলেদের ওপর চালানো হচ্ছে অমানবিক নির্যাতন। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে গত দুই মাসে ২০ জন জেলেকে অপহরণের তথ্য পাওয়া গেছে।
জেলেরা বলছেন, বনদস্যুদের সঙ্গে সবসময় ফোনের মাধ্যমে লোকালয়ের কিছু মানুষ যোগাযোগ করছে। কখন কোন নৌকা নামছে, কোন এলাকায় যাচ্ছে, তার তথ্য চলে যাচ্ছে বনদস্যুদের কাছে। লোকালয়ে তাদের একাধিক সদস্য কাজ করছে। সুন্দরবন জুড়ে নতুন করে দস্যুতা শুরু হওয়ায় জীবন-জীবিকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বনজীবীরা। অনেকেই এই পেশা ছেড়ে ইটভাটায় কাজ করতে চলে গেছেন। আবার অনেকে বনদস্যুদের চাঁদার টাকা ম্যানেজ করতে না পেরে সুন্দরবনে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, প্রশাসন চাইলেই মুক্তিপণ আদায়ের বিকাশ নম্বর ট্র্যাকিং করে জলদস্যুদের শনাক্ত করা সম্ভব।
সবশেষ শনিবার (২১ ডিসেম্বর) সকালে দেখা গেছে শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ বাজারে সুন্দরবন থেকে ফিরে আসছেন দুই বনজীবী। তাদের দুইজনের হাতেই দুইটা ব্যাগ। কাপড়সহ শরীরে লেগে ছিল সুন্দরবনের কাদামাটি। চেহারায় আতঙ্কের ছাপ।
জানা গেলো গত ১৪ ডিসেম্বর সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের কদমতলা স্টেশন থেকে পাস নিয়ে সুন্দরবনে কাঁকড়া শিকার করতে প্রবেশ করেছিলেন তারা। গত ১৫ ডিসেম্বর সুন্দরবনের পুষ্পুকাটি এলাকার মেটে খাল থেকে কাঁকড়া মারার সময় বনদস্যু মজনু বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিপণের দাবিতে তাদেরকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে তাদের ওপর চলে অমানবিক নির্যাতন। এক সপ্তাহের বেশি সময় সেখানে আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে তাদের। পরে পরিবারের মাধ্যমে তারা দুইজন এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে মুক্তি পেয়েছেন। পরে বনদস্যু মজনু বাহিনীর সদস্য আলিফ দাতিনাখালির এক জেলের নৌকায় তাদের উঠিয়ে দিয়ে বুড়িগোয়ালিনীতে নামিয়ে দিতে বলেন।
শুধু এই দুই জেলেই নয়, গত ১৭ ডিসেম্বর ৩ জেলেকে অপহরণ করে বনদস্যুরা। অপহৃত জেলেরা হলেন- সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার হরিনগর গ্রামের নাজির সরদারের ছেলে রেজাউল ইসলাম (৩৮), গোলাম মোস্তফার ছেলে সুজন গাজী (২৭) ও খুলনার কয়রা উপজেলার দশালি গ্রামের শের আলী মোল্লা ওরফে কবিরাজের ছেলে এমদাদুল হক (৩৩)।
গত ৮ নভেম্বর সুন্দরবনের মালঞ্চ নদের সাতনলা দুনে এলাকায় মাছ ধরার সময় অস্ত্রধারী বনদস্যু বাহিনীর হাতে জিম্মি হন খুলনার কয়রা উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের আতাহার হোসেন (৩৫) ও রফিকুল ইসলাম (৩৮)।
বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে সুন্দরবন অঞ্চলের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন দস্যু ৪৬২টি অস্ত্র ও ২২ হাজার ৫০৪টি গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করে। পরে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়।
ভেটখালী গ্রামের জেলে নজরুল ইসলাম। তিনি বনদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার হয়েছেন।
তিনি জানান, ৩১ অক্টোবর সকালে সুন্দরবনের ধানুখালী এলাকা থেকে মঞ্জুর বাহিনী পরিচয়ে ডাকাতরা তাকে অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি করে। টাকা দিতে আপত্তি করায় আটকে রেখে বেদম মারপিট করে। ৩ নভেম্বর সকালে সুন্দরবনের তক্কাখালী এলাকায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালাতে গেলে দস্যুরা বন বিভাগের সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। জবাবে বনকর্মীরাও পাল্টা গুলি ছোড়েন। এ সময় প্রতিরোধের মুখে বনদস্যুরা পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে অপহৃত ১০ জেলে, ৩টি নৌকা, ১টি সোলার প্যানেল ও ১টি গুলি উদ্ধার করা হয়।
সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মশিউর রহমান সংবাদমাধ্যমকে জানান, সুন্দরবন থেকে বনদস্যু নির্মূল করতে টহল বাড়ানো হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুলিশ, বনবিভাগ যৌথভাবে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করবে।
শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সুন্দরবনে একাধিক জেলেকে অপহরণ করা হয়েছে এমন তথ্য পেলেও কেউ দস্যুদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করতে চায় না। তারপরও তাদের দস্যুতা বন্ধে আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করছি। আমরা সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুন্দরবনে বনদস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে।