সচ্চিদানন্দদেসদয়: ঢাক,কাঁসরের বাদ্য-বাজনা, রাত্রি উজ্জ্বল করা আরতি ও পূজারি-ভক্তদের পূজা-অর্চনায় কেবলই মা দুর্গার বিদায়ের আয়োজন। কারণ আজ মঙ্গলবার শুভ বিজয়া দশমী। গত পাঁচদিন পূজা উদযাপন শেষে সব পূজামন্ডপেই এখন বিষাদের ছায়া। সোমবার মহানবমী পালনের পর আজ বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ এই ধর্মীয় উৎসবের।দুর্গা পূজার অন্ত চিহ্নিত হয় বিজয়া দশমীর মাধ্যমে। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, এই দিনেই পিতৃ-আবাস ছেড়ে দেবী পাড়ি দেন স্বামীগৃহ কৈলাসের দিকে। এই দিনেই তাই দেবীর প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়। ভারত ও নেপালের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দিনটি নানাভাবে পালিত হয়ে থাকে। ‘দশমী’ কথাটির প্রাসঙ্গিক তাৎপর্য সহজবোধ্য। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে দেবী কৈলাস পাড়ি দেন। সেই কারণেই ‘বিজয়া দশমী’ নাম। কিন্তু এই দশমীকে ‘বিজয়া’ বলা হয় কেন, তার পৌরাণিক ব্যাখ্যা খুঁজতে গেলে একাধিক কাহিনি সামনে আসে। পুরাণে মহিষাসুর-বধ সংক্রান্ত কাহিনিতে বলা হয়েছে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ৯ রাত্রি যুদ্ধ করার পরে দশম দিনে তার বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেন দেবী। শ্রীশ্রীচন্ডীর কাহিনি অনুসারে, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে দেবী আবির্ভূতা হন, এবং শুক্লা দশমীতে মহিষাসুর-বধ করেন। বিজয়া দশমী সেই বিজয়কেই চিহ্নিত দেবী দুর্গার বিদায়ের দিনে বিষাদের সুরেই বিজয়া দশমী পালন করে মর্ত্যবাসী। বিজয়া দশমীতে মা দুর্গাকে বিদায় জানানোর দিন। এই দিনটি শেষ হয় মহাআরতির মাধ্যমে। এর মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার সব কার্যক্রম সম্পন্ন হয়।সর্বশেষ যে রীতিটি পালিত হয়, এর নাম “দেবী বরণ”। এটি শুরু হয় বিবাহিত নারীদের সিঁদুর খেলার মাধ্যমে। বিবাহিত নারীরা সিঁদুর, পান ও মিষ্টি নিয়ে দুর্গা মাকে সিঁদুর ছোঁয়ানোর পর একে অপরকে সিঁদুর মাখিয়ে দেন। তাঁরা এই সিঁদুর মাখিয়ে দুর্গা মাকে বিদায় জানান। দুর্গাকে নিয়ে যাওয়ার আগে সিঁথিতে সিঁদুর মাখানোর পর আঙুলে লেগে থাকা বাকি সিঁদুর তারা একে অপরের মুখে মাখেন। এই সিঁদুর মাখার রীতি অনেক সময় দশমী ঘরে পালন করা হলেও অনেকে আবার নিজেদের ঘরেই খেলে থাকেন।এই রীতির অন্যতম গুরুত্ব হলো, বিবাহিতরা তাদের সিঁদুরের স্থায়িত্ব অর্থাৎ তাদের স্বামীর দীর্ঘ জীবন কামনার উদ্দেশ্যেই তাঁরা এই সিঁদুর খেলা খেলে থাকেন। এ কারণেই সম্ভবত বিধবা নারীদের এই খেলার রীতির প্রচলন নেই। কারণ বিধবারা সিঁথিতে সিঁদুর পরতে পারেন না।বাঙালি হিন্দু নারীরা তাদের প্রথাগত ও ঐতিহ্যবাহী কাপড় পরে দুর্গার পায়ে সিঁদুর মাখেন। এরপর নিজেদের মুখে মাখেন। তাদের স্বামীর দীর্ঘ জীবন ও সুখ-শান্তি কামনা করেন। এভাবে পালিত হয় তাঁদের সিঁদুর খেলা। আর এই খেলা হিন্দুধর্মাম্বলীদের জন্যে প্রয়োজনীয়, কারণ তাঁদের মতে জীবনসঙ্গিনীর দীর্ঘ জীবন কামনা এই পূজার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। বিশ্ব সংসারে ঐক্য ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। আর এখানেই বিজয়া দশমীর বিশেষত্ব অন্যরকম বলে মনে করা হয়।শেষবারের মতো দেবীর আশীর্বাদ কামনায় নারী, পুরুষ, শিশু-কিশোর সব বয়সের ভক্ত নিবিষ্ট মনে প্রার্থনা করেন। কীর্তন-শ্যামা সঙ্গীতের মধুর সুর আর ভক্তদের কলকাকলিতে বিভিন্ন পূজামন্ডপে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের রঙ। প্রতিটি মন্ডপেই কয়েক দফা করে পুষ্পাঞ্জলি দেয়া হয়। বিদায় বেলায়ও চলেছে ঢাক আর শঙ্খধ্বনি, টানা মন্ত্র পাঠ, উলুধ্বনি, অঞ্জলি, ঢাকের বাজনার সঙ্গে ধুনচি নৃত্য। সন্ধ্যায় মন্ডপে মন্ডপে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।