
জহুরুল কবীর: স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও চিহ্নিত পূর্বক রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি ’৭১ এর গণহত্যার শিকার শহীদদের গণকবর ও বদ্ধভ‚মি সমূহ। জেলা ব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য গণকবর ও বদ্ধূভ‚মি। সাতক্ষীরা শহরের সরকারি উচ্চবিদ্যালয় সংলগ্ন দীনেশ কর্মকারের ভিটাটি আজ বেদখল হয়ে গেছে। এব্যাপারে গত দুবছর আগে সাতক্ষীরা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ত, জাসদ, বাসদ, ওর্য়ার্কাস পাটিসহ স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব স্বরজমিন প্রদর্শনে যান। উক্ত স্থানে উপস্থিত থেকে জেলা প্রশাসক মোস্তাফা কামাল বলেন, ‘বদ্ধভ‚মি জায়গাটির দখল সংক্রান্ত জটিলতা নিরাসন করা হবে এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে’। এব্যাপারে গতকাল জেলা প্রশাসক মোস্তফা কামালের নিকট জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘দুবছর আগেই এডিসি রেভিনিউকে এসিল্যান্ডের সাথে কথা বলে ভ‚মি সংক্রান্ত জটিলতা নিরাসন করতে বলেছি’। তিনি এব্যাপারে গভীর আন্তরিকতা প্রকাশ করেন। তবে এব্যাপারে সাতক্ষীরা ২-তালা-কলারোয়ার সাংসদ অ্যাড. মোস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেন, ‘আমি নিজে বহুবার এব্যাপারে জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলেছি, কোন ফল আসেনি’। মোস্তফা লুৎফুল্লাহ জেলা প্রশাসকের বক্তবের প্রতি প্রশ্ন রেখে বলেন,‘ ডিজিটাল এই যুগে জেলা প্রশাসকের এই কাজ করতে কত বছর লাগবে’?
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যাকাÐ চালায়। এ ধরনের হত্যাকাÐ বিশ্বে নজিরবিহীন। এখনো আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি। বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হয় ৩০ লাখ মানুষ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় এ হত্যাকাÐ চলে। বধ্যভ‚মিতে অসংখ্য মাথার খুলি, হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে। সাতক্ষীরার গণহত্যা, বধ্যভ‚মি ও গণকবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো।
শহরের গণকবর: সাতক্ষীরা শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকার মধ্যেই রয়েছে পাঁচটি গণকবর। জেলায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে আরও পাঁচটি বধ্যভ‚মি। হত্যাযজ্ঞের চিহ্ন হিসেবে স্বাধীনতার পর এসব বধ্যভ‚মি ও গণকবর থেকে অসংখ্য মানুষের মাথার খুলি, হাড় ও কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এব্যাপারে একজন মুক্তিযোদ্ধা জানান, ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল খুলনা, বাগেরহাট, ৯৬ গ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৬০০ থেকে ৭০০ নির্যাতিত মানুষ ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সাতক্ষীরা আসেন। তাঁরা ‘বর্তমান সাতক্ষীরা সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়’-এ আশ্রয় নেন। পরদিন সন্ধ্যায় হানাদার বাহিনী তাঁদের নৃশংসভাবে হত্যা করে।
বাঁকাল ব্রিজ বধ্যভ‚মি: সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ সড়কের বাঁকাল ব্রিজটি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের অন্যতম একটি স্থান। এখানে মুক্তিকামী বাঙালিদের গুলি করে কিংবা জবাই করে ব্রিজের নিচে ফেলে দেওয়া হতো।
ভাড়ুখালী-মাহমুদপুর স্কুলের পেছনের পুকুর বধ্যভ‚মি: সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ভাড়ুখালী-মাহমুদপুর স্কুলের পেছনের পুকুর থেকে স্বাধীনতার পর উদ্ধার করা হয় কয়েক শ মানুষের কঙ্কাল। সাতক্ষীরার দ্বিতীয় বৃহৎ গণকবর ছিল এটি।
ঝাউডাঙা বধ্যভ‚মি : সাতক্ষীরা সদরের ঝাউডাঙায় স্বাধীনতার কয়েক দিন আগে ভারতে যাওয়ার পথে গুলি করে হত্যা করা হয় কয়েক শ বাঙালি নারী, পুরুষ ও শিশু শরণার্থীকে। পরে তাদের গোবিন্দকাটি খালপাড় ও রূপালী ব্যাংকের পেছনে গণকবর দেওয়া হয়। এলাকাবাসী স‚ত্রে জানা গেছে, হানাদার বাহিনী সাতক্ষীরা শহরে আসার সময় ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল সাতক্ষীরার ঝাউডাঙা বাজারে বেশ কিছু লোককে গুলি করে হত্যা করে ওই বাজারের পাশে গণকবর দেয়। ২১ এপ্রিল ভোরে হানাদার বাহিনী সাতক্ষীরা শহরের সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া বহু মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। পরে তাঁদের বিদ্যালয়সংলগ্ন দীনেশ কর্মকারের ভিটায় গণকবর দেওয়া হয়।
পালপাড়া খালের বধ্যভ‚মি: শহরের সুলতানপুর পালপাড়া খালের ধারে হত্যা করা হয় বাঙালিদের। এখানেই হত্যা করা হয় সুরেন, নরেন ও কেষ্টপদ নামের তিন মুক্তিকামী যুবককে। এ ছাড়া বাঁকাল ব্রিজ এলাকা, পারকুমুরিয়া, রাঢ়িপাড়া, মুরারিকাটি, জালালপুর, কিসমত ইলিশপুর, কলারোয়া ফুটবল মাঠের দক্ষিণ পাশ, হরিনগর, বড়দল দেবহাটা, বৈচনা, পারুলিয়াসহ ২৫ থেকে ৩০টি স্থানে এমন গণকবর বা বধ্যভ‚মি রয়েছে।