স্পোর্টস ডেস্ক :
১৯৯৭ সালের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আকরাম খান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।১৯৯৭ সালের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আকরাম খান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
একটা সময় বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে মাতিয়ে রাখতো শুধু ফুটবল। সেই জায়গায় ক্রিকেটের অবস্থান ছিল ভীষণ নড়বড়ে। ১৯৯৪ সালে আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ দলের ব্যর্থতার পর পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিব্রতকর পরিস্থিতির মাঝে পড়ে যান ক্রিকেট সংগঠক থেকে শুরু করে ক্রিকেটাররাও। ক্রীড়াঙ্গনের আমূল পরিবর্তনটা ঘটেছে ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের পর। ক্রিকেটের নবজাগরণের মূল ভিতটাই স্থাপন করে দেয় এই ট্রফি।
অবশ্য সেদিনকার ঐতিহাসিক সেই জয় মোটেও সহজ ছিল না। পাহাড়সম চাপ নিয়ে কুয়ালালামপুরে কেনিয়ার মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। নেতৃত্বে ছিলেন আকরাম খান। বৃষ্টির কারণে ফাইনাল ম্যাচটি গড়িয়েছে দুই দিনে। বাংলাদেশের জয়ের জন্য ১ বলে প্রয়োজন ছিল ১ রান। এমন সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে তখন হাসিবুল হোসেন শান্ত। মার্টিন সুজি সেদিন শান্তকে আটকাত পারেননি। প্রয়োজনীয় রান নিয়েই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করে লাল-সবুজের দেশ। বৃহস্পতিবার আইসিসি ট্রফি জয়ের ২৬ বছর পূর্ণ হয়েছে। ঐতিহাসিক দিনটিতে সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমান বিসিবির পরিচালক আকরাম খান বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা বলেছেন।
আইসিসি ট্রফি জয়ের ২৬ বছর পূর্তির দিন আজ। পেছন ফিরে তাকালে কেমন অনুভূতি হয়?
আকরাম খান: আজ তো ২৬ বছর হয়ে গেলো। বাংলাদেশে এখন এত বড় বড় খেলোয়াড়; এসব দেখে ভালো লাগে। ১৯৯৭ সালে আমরা যদি আইসিসি ট্রফিতে কোয়ালিফাই না করতাম- তামিম, সাকিব, মাশরাফি, তাসকিন, মোস্তাফিজদের এভাবে দেখতে পেতাম না। হয়তো তারা খেলতো, কিন্তু এই পর্যায়ে এভাবে ডমিনেট করতে পারতো না। এজন্য শুকরিয়া আদায় করি, শুরুটা আমাদের দিয়েই হয়েছিল। এখন যে পর্যায়ে হকি আছে, ব্যাডমিন্টন আছে, ক্রিকেট সেই পর্যায়েই ছিল। কেননা, তখন আমাদের কোনও স্ট্রাকচারই ছিল না। কোনও মাঠ ছিল, ছিল না অনুশীলনের জায়গা। ৬ মাসের জন্য আমরা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম পেতাম খেলার জন্য, ওখানের সুযোগ সুবিধা নিয়েই খেলতাম। সেই জায়গা থেকে আজ ক্রিকেট এমন স্থানে চলে এসেছে যে অনেক মাঠ, এতগুলো ইনডোর, সুযোগ-সুবিধা; এসব চিন্তা করলে খুবই ভালো লাগে।
১৯৯৪ সালে ফেভারিট হয়েও ট্রফি জিততে পারেননি। ফলে ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি খেলতে যাওয়া আপনাদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জের ছিল কিনা?
আকরাম: অবশ্যই। ১৯৯৪ সালের দলটাও ভালো ছিল। আমরা ফেভারিট ছিলাম। তারপরও পারিনি। সত্যিকার অর্থে আমরা যেমন দল ছিলাম, ওই আসরে তেমনটা খেলতে পারিনি। এমনিতেই ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা কম, তার মধ্যে আমাদের ব্যর্থতা। সব মিলিয়ে ক্রিকেট নিয়ে সবার ভেতর হতাশা চলে এসেছিল। মানুষজন সমালোচনা করছিল। ফলে ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি আমার জন্য বাঁচা-মরার লড়াই হয়ে উঠেছিল। শেষ সুযোগের মতো আর কী…। আমাদের চিন্তা একটাই, ক্রিকেটকে বাঁচাতে হলে এবং খেলতে হলে এখানে কোয়ালিফাই করার বিকল্প নেই। ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ থেকে ক্রিকেটটাই উঠে যেত। তখন ফুটবল বাংলাদেশের নাম্বার ওয়ান স্পোর্টস। শেষ পর্যন্ত আমরা কোয়ালিফাই করে বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছি। আমি মনে করি, ক্রিকেট এই পর্যায়ে আসার পেছনে এই ট্রফির ভূমিকা অনেক।
১৯৯৭ সালের ১২ এপ্রিল আপনারা বৃষ্টির কারণে ব্যাটিং করতে পারেননি; পরে রাতটা কীভাবে কেটেছিল?
আকরাম: খুব স্বাভাবিকভাবেই ভীষণ হতাশ ছিলাম। ওরা অনেক বেশি রান করেছিল। সবার মধ্যে ভীষণ অস্থিরতা কাজ করছিল। স্বস্তি নিয়ে ঘুমাতে পারিনি। এরমধ্যে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। ফলে মাঠের আউটফিল্ড আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। সব মিলিয়ে নানান টেনশন তো ছিলই। সবচেয়ে বড় টেনশন ছিল ব্যর্থতার ভয়। এবার যদি ব্যর্থ হই, তাহলে হয়তো ক্রিকেট নিয়ে এগিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য কঠিন হবে।
ট্রফি জয়ের আগের মুহূর্তে ড্রেসিংরুমের আবহ কেমন ছিল?
আকরাম: ফাইনাল ম্যাচটি আমাদের সবার মনে আছে। আপনারা জানেন কেনিয়া শক্তিশালী দল ছিল। ওদের ব্যাটসম্যান-বোলাররাও উঁচুমানের। ওদের ফিজিক্যাল ফিটনেসও ভালো। কার্টেল ওভারে ১৬৬ রান করা সেই সময় সহজ লক্ষ্য ছিল না। এছাড়া বৃষ্টির কারণে মাঠের আউটফিল্ড স্লো হয়ে গিয়েছিল। পাইলট ও শান্ত খুব ভালো খেলেছে। পাইলট প্রথম বলে ছয় মেরেই ম্যাচটা আমাদের দিকে নিয়ে এসেছে। পুরো টুর্নামেন্ট আমরা টিম হিসেবে খেলতে পেরেছিলাম। দলের সবাই আমাকে সাহায্য করেছে। তাতে অধিনায়ক হিসেবে কোনও চাপ অনুভব করিনি। বিসিবি থেকে শুরু করে টিম ম্যানেজমেন্ট ও সাংবাদিকদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
জয়ের পর প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনার কাছ থেকে কল পাওয়ার অনুভূতি কেমন ছিল?
আকরাম: আমাদের পরিকল্পনা ছিল ফাইনাল জিতে শপিংয়ে যাবো। তবে শপিংয়ে আর যাওয়া হয়নি। ম্যাচ জেতার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ফোন পাই। তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তিনি আমাদের বললেন, ‘তোমরা আজই (১৩ এপ্রিল ১৯৯৭) চলে এসো।’ তখনও বুঝতে পারিনি আমাদের জন্য কী আয়োজন হচ্ছে। যেহেতু তখন বিদেশ যাওয়াটা আমাদের জন্য সহজ ছিল না। ফলে শপিং করতে না পেরে কিছুটা মন খারাপ হয়েছিল! প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্য প্রাইভেট প্লেন পাঠিয়ে দিলেন। আমরা চলে আসছি, কিন্তু জানতাম না এত কিছুর আয়োজন হচ্ছে। এয়ারপোর্ট থেকে তার বাসায় গেলাম। খাওয়া দাওয়ার পর তিনি বললেন, ‘চলো আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে। তখনও কিছু বুঝিনি। যখন বাস থেকে নেমে স্টেজে গেলাম, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কম করে হলেও এক লাখের বেশি লোক হবে। এই সংবর্ধনাই আজ বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এতটা জনপ্রিয় করেছে। ওই সংবর্ধনার পর থেকে ক্রীড়াঙ্গনে এক নম্বরে চলে আসে ক্রিকেট।
আকরাম: অনেক ভালো অনুভূতি। আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। এখন পর্যন্ত ক্রিকেটের যত ভালো ভালো অর্জন হয়েছে, সবখানে কোনও না কোনোভাবে আমি ছিলাম এবং আছি। অধিনায়ক হিসেবে ওই ট্রফিটা আমার হাতে উঠেছে। এটা আমার জন্য দারুণ প্রাপ্তির ব্যাপার। ধন্যবাদ আমার আম্মাকে। আম্মা সবসময় অনুপ্রেরণা দিতেন। বলতেন, ‘তোমাকে দিয়ে এমন কিছু হবে।’ তার কথায় সবসময় আত্মবিশ্বাস পেতাম। কেবল মাকেই নয়, ধন্যবাদ জানাই প্রধানমন্ত্রীকেও। তখন ক্রিকেট এত পরিচিত ছিল না। বাংলাদেশের প্রথম কোনও অর্জন। উনি যদি সংবর্ধনা না দিতেন, তাহলে হয়তো সবার মধ্যে আকর্ষণ জন্ম নিতো না।
ফাইনালের আগে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে অধিনায়কোচিত ৬৮ রানের ইনিংস খেলে দলকে জিতিয়েছিলেন। ওই ইনিংসটিকে আইসিসি ট্রফি জয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা হিসেবে দেখা হয়। সেই ম্যাচটি নিয়ে শুনতে চাই…
আকরাম: আমরা ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফির শুরু থেকেই ভালো খেলছিলাম। বৃষ্টির জন্য আমাদের একটি পয়েন্টে হারাতে হয়েছিল। ওই ম্যাচটি যদি টাই হতো, তাহলে আমরা সেমিফাইনালে কোয়ালিফাই করতাম না। আমাদের জিততেই হবে- এমন একটি সমীকরণ সামনে ছিল। ব্যাটিংয়ের শুরুতে আমরা চার উইকেট হারিয়ে ফেলি। ওই হারতে বসা ম্যাচটি আমরা জিতে যাই শেষ পর্যন্ত। আমি ম্যাচসেরা ইনিংস খেলেছিলাম। খুব স্বাভাবিকভাবেই ওই ইনিংসটার কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। আমার ক্যারিয়ারে অন্যতম সেরা ইনিংস হিসেবে এটা থাকবে। এই ইনিংসের কথা মনে পড়লে আমার গর্ব হয় যে এমন একটা ইনিংস দেশের জন্য খেলতে পেরেছি। সত্যি কথা বলতে ওই জয়টা আসলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য প্রয়োজন ছিল।
আকরাম: ২৬ বছর হয়ে গেলো…। লম্ব সময় চলে গেছে। আমি মনে করি একটা ‘গেট টুগেদার’ হওয়া উচিত ছিল। ক্রিকেট বোর্ড বলেন আর কোয়াব, কাউকে না কাউকে এই উদ্যোগটা নেওয়া উচিত ছিল। নতুন জেনারেশনকে এই জিনিসগুলো জানানো উচিত। আমার মনে হয় এই ব্যাপারে বোর্ডকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। সবার জানা উচিত আজকের এই ক্রিকেট আগে কোথায় ছিল, কারা এই অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। এসব কিছু বর্তমান জেনারেশন না জানলে বড় একটা গ্যাপ হয়ে যাবে।