
জি, এম নজরুল ইসলাম শ্যামনগরঃ সুন্দরবন-প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়, জীবনের রক্ষাকবচ। কিন্তু সেই বনাঞ্চল ও বঙ্গোপসাগরের বুক জুড়ে আজ ছড়িয়ে পড়েছে আলিফ বাহিনীর আতঙ্ক। দু’মাসের বাজার, পানি ও অস্ত্র মজুদ করে যেকোনো সময় জেলেদের ওপর হামলার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে এই কুখ্যাত জলদস্যু দল। সদ্য মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা এক জেলে, ছদ্মনামে আজহারুল ইসলাম,
রবিবার দুপুরে একান্ত সাক্ষাৎকারে জানান, এবার দস্যুদের প্রস্তুতি আরও সুসংগঠিত। গত ২৬ জানুয়ারি মান্দারবাড়িয়া এলাকায় তিন দস্যু আটকের ঘটনার পর তারা বহরে যুক্ত করেছে কোটি টাকার অস্ত্র ও প্রযুক্তি। বর্তমানে পশ্চিম সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চলে ৪-৫টি দস্যুদল সক্রিয়, তবে সবচেয়ে ভয়াবহ ও সংগঠিত বাহিনী হিসেবে উঠে এসেছে আলিফ বাহিনী। এই বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছে আলিফ ওরফে দয়াল বাবা, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাঘা মজিদ, রবিউল, সঞ্জয় মালো, আব্দুল্লাহ, খোকাবাবু সহ রামপাল ও মোংলার সাবেক ও বর্তমান দস্যুরা।
এক সময় ৬-৭ জনের ছোট্ট একটি দল থেকে আজ তারা পরিণত হয়েছে ১৮ জনের সশস্ত্র বাহিনীতে, যাদের হাতে রয়েছে ২টি ৪-সিলিন্ডার ট্রলার, ৪টি ওয়াকিটকি এবং ১৯টি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র- যার মধ্যে রয়েছে ডাবল ও সিঙ্গেল ব্যারেল বন্দুক, চাইনিজ রাইফেল,
নাইন এমএম, সিক্স শুটার ও এইট শুটারগান।
জানা গেছে, আলিফ বাহিনী এখন সাবেক দস্যুদের পুনরায় সংগঠিত করে নতুন করে সাগরে দস্যুতা চালানোর পরিকল্পনা করছে। তাদের দলে যোগ দিতে দেখানো হচ্ছে অর্থ, নিরাপত্তা ও আত্মসমর্পণের সুবিধার প্রলোভন। অন্যদিকে, উপকূলজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ভয় ও অনিশ্চয়তা।
আশাশুনি উপজেলার চাকলার এক জেলে জানান, আলোরকোলের জেলেরা এখন আলিফ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। ভয়ে ঠিকমতো মাছ ধরতেও পারছে না।
চন্ডিপুর গ্রামের আবু হাসান বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারিতে মজনু বাহিনীর হাতে জিম্মি হওয়া ১৯ জন জেলেকে মুক্ত করতে মাথাপিছু ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা করে মোট ৫৩ লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে হয়েছিল। সেই ক্ষতি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আবার যদি নতুন করে কিছু হয়, তাহলে পথে বসতে হবে।
আলোরকোলের চাকলা বেল্টের সভাপতি আব্দুর রউফ মেম্বার জানান, এ বছর কোস্টগার্ড বেশ তৎপর। বেয়লা-কয়লার প্রবেশপথে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল চলছে নিয়মিত। তবুও আতঙ্ক পুরোপুরি কাটেনি। এদিকে, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনী জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিয়মিত টহল ও নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে।
তারা জানিয়েছে, জেলেরা যেন নির্বিঘ্নে মৎস্য আহরণ করতে পারে, তা নিশ্চিত করাই আমাদের অগ্রাধিকার।
তবে বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) এ জেড এম হাসানুর রহমান বলেন, সাগরে দস্যু প্রতিহত করার মতো যানবাহন আমাদের নেই, তবে সুন্দরবনে দস্যুতা নির্মূলে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। সুন্দরবনের বুকে আবারও দস্যুতার ছায়া ঘনিয়ে আসছে। আলিফ বাহিনীর মতো সংগঠিত চক্রের বিরুদ্ধে দ্রুত, সমন্বিত ও কঠোর পদক্ষেপ না নিলে জেলেদের জীবন-জীবিকা যেমন হুমকির মুখে পড়বে, তেমনি সুন্দরবনের নিরাপত্তাও হবে চরমভাবে বিপন্ন।
প্রকৃতির এই রত্নভাণ্ডারকে রক্ষা করতে হলে দস্যুতা, দালালচক্র ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে একসঙ্গে দাঁড়াতে হবে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জনগণকে।

