
ইসলাম শান্তি, শৃঙ্খলা, পারস্পারিক সম্প্রীতি ও সহানুভূতির ধর্ম। একই দেশের নাগরিকদেরকে মেজোরিটি ও মাইনোরিটি সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু বিবেচনায় বিভাজনের কোনো অবকাশ ইসলামে নেই। ইসলাম হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ধর্ম। বহুজাতিয় সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা একমাত্র ইসলামী বিধানানুযায়ী সম্ভব। ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিম-অমুসলিম, ধর্মীয় সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু সকলেরই নাগরিক অধিকার সমান। সামান্যও পার্থক্য নেই।
ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসরত যেকোনো ধর্মের নাগরিক নিজ ধর্ম-কর্ম পালনসহ সকল মানবাধিকার লাভ করে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কোনো প্রকার অন্যায় অত্যাচার, নির্যাতন, নিপিড়নের কোনো বৈধতা ইসলামে নেই।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে ন্যায়বিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে।ন্যায় বিচার করবে, ইনসাফ করবে, এটাই তাকওয়া-খোদাভীতির নিকটতর। নিশ্চয় আল্লাহ তোমরা যা করো তার খবর রাখেন।” (সুরা মায়িদা, আয়াতঃ ৮)
আল্লাহ আরো বলেন, “দ্বীন ইসলামের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার বাড়া-বাড়ি বা জোর-জবরদস্তি নেই “। (সুরা বাকারাঃ ২৫৬) অর্থাৎ কোনো অমুসলিমকে ইসলাম গ্রহনের জন্য বল প্রয়োগ করা যাবেনা। ইসলাম মানুষকে মানুষ হিসাবে সম্মান দিতে শিখায়।মানুষের মানবিক মর্যাদার ক্ষেত্রে ধর্মের বিবেচনা ইসলামের কাছে গৌণ।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “নিশ্চিত আমি আদম সন্তানকে সম্মান দান করেছি।”(সুরা বণি ইসরাইল ঃ ৭০)
ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) শুধু মানব জাতিই নয় সকল জীবের প্রতি দয়া, সম্মান, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, ভালবাসা ও সদাচরণ প্রদর্শনের শিক্ষা দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, “সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার, যে আল্লাহর পরিবারকে ভালবাসে সে-ই আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয়। “সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয় এমন কোনো বিধান ইসলামে নেই।
হযরত মুহাম্মদ সাঃ মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে মদীনায় বসবাসরত বহুজাতিয় নাগরিকদেরকে নিয়ে সন্ত্রাস, দূর্নীতি ও শঙ্কা মুক্ত একটি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়া সত্ত্বেও সকল ধর্মের অনুসারী নাগরিকদের সার্বিক নাগরিক অধিকার সুনিশ্চিত করেছিলেন। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকদের মানবিক ও ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে তিনি একটি ঐতিহাসিক চুক্তি করেছিলেন ইতিহাসে যা মদিনা ‘সনদ নামে’ পরিচিত। এই সনদের উল্লেখযোগ্য ধারাগুলো ছিল:
১. সনদে স্বাক্ষরকারী মুসলমান,ইহুদি,খৃস্টান,পৌত্তলিক সকল সম্প্রদায়ের লোকেরা সমান অধিকার লাভ করবে।
২. সকলের পূর্ন ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে।কেউ কারো ধর্মে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করবেনা।
৩. হত্যা, রক্তপাতসহ সকল প্রকার অপরাধমূলক কার্যকলাপ একেবারেই নিষিদ্ধ।
প্রকৃতপক্ষে এই যুগান্তকারী সনদের মাধ্যমেই পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ,হানাহানিতে লিপ্ত বহুজাতিয় সম্প্রদায়গুলোর মাঝে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়।বিভিন্ন ধর্মের সর্বস্তরের নাগরিক সন্ত্রাসমুক্ত, শান্তিময় ও শঙ্কাহীন জীবন-যাপনের সুযোগ পায়।প্রত্যেক নাগরিক স্ব স্ব ধর্ম পালনের স্বাধীনতা লাভ করে। ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিম নাগরিকদের প্রতি গুরুত্বারোপ করে।
মহানবী সাঃ ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি কোনো জিম্মির(ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিম নাগরিক) প্রতি জুলুম, অত্যাচার, অনাচার করবে,মানহানি করবে,তাকে তার সামর্থের অধিক কাজে বাধ্য করবে অথবা তার সন্তুষ্টি ছাড়াই তার কোনো কিছু ছিনিয়ে নিবে,কিয়ামত দিবসে আমি তার প্রতিপক্ষ হবো।”(আবু দাউদ)
অন্য এক হাদিসে মহানবী সাঃ বলেন,” যে ব্যক্তি কোনো জিম্মিকে কষ্ট দেয় সে যেন আমাকেই কষ্ট দেয়।”
তিনি আরো বলেন,” অন্যায়ভাবে জিম্মিদের(সংখ্যালঘু)ধন সম্পদ ভোগ করা আদৌ হালাল নয়।”(আবু দাউদ)
হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর তিরোধানের পর খোলাফায়ে রাশেদিনগণ সংখ্যালঘুদের বেলায় তাঁর(মহানবী সাঃ) কথা ও কাজের পুরোপুরি অনুস্মরণ করতেন।তাঁরা অন্যান্য মুসলমানদেরকেও সংখ্যালঘুদের প্রতি সদাচরণে উৎসাহিত করতেন। তাদের অধিকার খর্ব করতে নিষেধ করেছেন।
প্রথম খলিফা হযরত আবুবকর (রাঃ) হিরা প্রদেশের গির্জাগুলো না ভাঙার নির্দেশ দেন।এবং গির্জার ঘণ্টা বাজানোর সুযোগদানের নির্দেশ দেন।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রাঃ)এর শাসনামলে জেরুজালেম অধিকৃত হলে তিনি খৃষ্টানদের ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকার অক্ষুন্ন রেখেছিলেন।মুসলমানরা একটি গির্জাকে মসজিদে রূপান্তর করলে তিনি প্রাদেশিক গভর্নরকে সেই মসজিদটি পুনরায় গির্জায় রূপান্তরিত করার নির্দেশ দেন।
জেরুজালেমের খৃষ্টানদের কাছে প্রেরিত চুক্তি পত্রে তিনি উল্লেখ করেন,জেরুজালেমের অধিবাসী খৃষ্টানদের জান মাল,উপসানালয়,ক্রস ইত্যাদির ব্যাপারে নিরাপত্তা দেয়া হলো।তাদেরকে তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের ব্যাপারেও নিরাপত্তা দেয়া হলো।
নবীযুগে ও খোলাফায়ে রাশেদিনের সোনালীযুগে অমুসলিমদের জন্য যতগুলি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে সেগুলোতে তাদের ধন-সম্পদ, সম্মান, সম্ভ্রম সংরক্ষণের পাশাপাশি স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার দেয়া হয়েছে।
এ ধরনের কিছু চুক্তি পত্রের নমুনা দেখলে আমরা সহজে বিষয়টা বুঝতে পারবো।
১. যুরজান জয়ের পর সেখানকার অমুসলিমদের উদ্দ্যেশে যে চুক্তিপত্র লেখা হয়েছিল তা নিন্মরূপ:
“যুরজানে বসবাসরত সকল অমুসলিম নাগরিকদের প্রাণ ও ধন-সম্পদের পূর্ন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হল।ধর্ম পালনে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হল।এতে কোনো রকমের পরিবর্তন সাধন করা হবেনা।”
২. হযরত হুযাইফা ইবনে ইয়ামান (রাঃ) মাহে দীনারের অধিবাসীদের উদ্দ্যেশে যে চুক্তিপত্র লিখেছিলেন তা নিম্নরূপঃ
“মাহে দীনারের অমুসলিম নাগরিকদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, রীতি-নীতিতে কোনোরূপ পরিবর্তন সাধিত হবেনা।তাদের ধর্মের ব্যাপারে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হবেনা।”
৩. আজারবাইজানের নাগরিকদের উদ্দ্যেশে লিখিত চুক্তিপত্র নিম্নরূপ:
“আজারবাইজানের অমুসলিম নাগরিকদের তাদের জীবন,ধন-সম্পদ ও ধর্মের ব্যাপারে নিরাপত্তা দেয়া হলো।”
৪. মুকান শহরের অধিবাসীদের উদ্দ্যেশে লিখিত চুক্তিপত্র নিম্নরূপ:
“মুকান শহরের অধিবাসীদেরকে তাদের জীবন,ধন-সম্পদ, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদির ব্যাপারে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলো।”
এসব চুক্তি কেবল কাগজে কলমে লিপিবদ্ধ ছিলনা বরং খোলাফায়ে রাশেদিন ও সমসাময়িক মুসলমানেরা এসব চুক্তি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)এর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত ইসলামের সুদীর্ঘ কালের ইতিহাস একথায় সাক্ষ্য দেয় যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেখানেই মুসলিম -অমুসলিমদের সহাবস্থান ছিল সেখানেই মুসলমানেরা অমুসলিমদের প্রতি সম্প্রীতি প্রদর্শন করেছেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মাধ্যমে শান্তি -শৃঙ্খলা বজায় রেখেছেন।
পরিশেষ একথা আমরা নির্দিধায় বলতে পারি যে,বাংলাদেশও তেমনি একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসাবে বিশ্বজুড়ে যার সুনাম সুখ্যাতি রয়েছে। অনাগত ভবিষ্যতেও এদেশের সেই সুখ্যাতি অক্ষুন্ন থাকুক এটাই আমাদের একান্ত কাম্য।
(লেখকঃ সহঃঅধ্যাপক (ইসলাম শিক্ষা), হাজী কেয়ামউদ্দীন মেমোরিয়াল মহিলা কলেজ ,দেবহাটা, সাতক্ষীরা।)