
বাণিজ্য ডেস্ক:
বিশ্বব্যাংকের বাজেট সহায়তার শর্ত মেনে সরকারকে আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরও বেশি পরিমাণে আদায় করতে হবে। তিন বছরে বাড়তি প্রায় এক লাখ কোটি টাকার আয়কর ও ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তবে এই অর্থ যেহেতু সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আদায় করা হবে, তাই তাদের ওপর করের চাপ বাড়ছে এবং বাড়বে।
কোভিডের প্রভাব কাটাতে এবং টেকসই উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ডেভেলপমেন্ট পলিসি ক্রেডিট (ডিপিসি) কর্মসূচির আওতায় ৭৫ কোটি ডলার পেতে চুক্তিবদ্ধ হয় সরকার। ইতিমধ্যে দুই কিস্তিতে ৫০ কোটি ডলার পাওয়া গেছে। তবে শেষ কিস্তি এখনো মেলেনি।
চলতি অর্থবছরের মধ্যে বাকি ২৫ কোটি ডলার পাওয়ার কথা থাকলেও তা আরও কয়েক মাস পিছিয়ে যেতে পারে।
কী করতে হবে
ডিপিসি ঋণ পেতে বিশ্বব্যাংক কিছু ‘লক্ষ্য’ বেঁধে দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে আয়কর ও ভ্যাট আদায় বাড়িয়ে ২ লাখ ৪৪ হাজার ২০০ কোটি টাকায় উন্নীত করা। মূলত কোভিডের প্রভাব কাটিয়ে বাজেটে নিজস্ব উৎস থেকে অর্থায়ন বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) এই লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।
যখন এই লক্ষ্য ঠিক করা হয়, তখন ২০২০-২১ অর্থবছরকে ভিত্তি ধরা হয়। ওই অর্থবছরে ওই দুই খাতে আদায় ছিল ১ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। তিন বছরের মধ্যে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বাড়তি কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়। অবশ্য ২০২১-২২ অর্থবছরেই কর আদায় বাড়ে এবং ২ লাখ কোটি টাকার আয়কর ও ভ্যাট আদায় হয়।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সময়ে এই দুই খাতে আদায় হয়েছে ৯৯ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। বাকি ছয় মাসে কত রাজস্ব আদায় হয়, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে। তবে বাংলাদেশকে আগামী অর্থবছরে ২ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে।
আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে দেশীয় শিল্প সুরক্ষামূলক হার অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি। বিশ্বব্যাংক বলেছে, আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় এই হার কমাতে হবে। বর্তমান এ হার ২৯ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে তা ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। আমদানি শুল্কের পাশাপাশি বাংলাদেশে মূলত সম্পূরক শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক দিয়েই আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বর্তমানে শূন্য শতাংশ থেকে শুরু করে ৫০০ শতাংশ পর্যন্ত সম্পূরক শুল্ক আরোপ হয়।
বিশ্বব্যাংক ছাড়া আইএমএফ-ও শুল্ক-কর আদায় বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। সাড়ে তিন বছরে ৪৭০ কোটি ডলার পাওয়ার অন্যতম শর্ত হলো শুল্ক-কর আদায়ের বর্তমান প্রবণতার বাইরে মোট দেশজ উৎপাদনের জিডিপি) দশমিক ৫ থেকে দশমিক ৭ শতাংশ অতিরিক্ত কর প্রতিবছর আদায় করতে হবে। এ ছাড়া, কর অব্যাহতি কমানোর শর্তও রয়েছে।
সাধারণ মানুষের ওপর চাপ
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক—দুটি বড় সংস্থাই শুল্ক-কর আদায় বৃদ্ধির কথা বলেছে। এই বাড়তি শুল্ক-কর আদায় বৃদ্ধি করতে করদাতা ও সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়বে, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
এনবিআরের সাবেক সদস্য আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমদানি শুল্কের পরিমাণ কমবে। তখন আয়কর ও ভ্যাটের ওপর চাপ বাড়বে। বর্তমানে বৈশ্বিক ও স্থানীয় পরিস্থিতির কারণে আমদানি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এর ফল স্বাভাবিকভাবেই আয়কর ও ভ্যাট আদায়ের ওপর প্রভাব ফেলবে।’
প্রথম আলোকে তিনি আরও বলেন, ‘কর-জিডিপি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিতে হলে বর্তমানে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির প্রবণতা দিয়ে চলবে না; বরং বড় লাফ দিতে হবে। তিন বছর আগে আমদানি, ভ্যাট ও আয়কর—তিন খাতেই সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এসব সংস্কারের কথা শুধু শুনছি, বাস্তবে হচ্ছে না। এনবিআর যদি আক্ষরিক সংস্কার চায়, তাহলে না হওয়ার কারণ নেই।’ তিনি রাজস্ব প্রশাসনের জবাবদিহির ওপর জোর দেন।
আদায় বাড়াতে এনবিআর কী করছে
আয়কর ও ভ্যাট আদায় বাড়াতে গত এক বছরে এনবিআর নানা উদ্যোগ নিয়েছে। গত ২৩ জানুয়ারি নতুন আয়কর আইন মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আগামী বাজেট অধিবেশনে তা পাসের জন্য জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হতে পারে। অনলাইনে ভ্যাট রিটার্ন জমার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ভ্যাট আদায় বাড়াতে আগামী পাঁচ বছরে তিন লাখ ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসানোরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এবার শুধু বড় শহর নয়, উপজেলা সদর পর্যায়েও ইএফডি মেশিন বসানো হবে।
এ ছাড়া উৎস কর কর্তনের জন্য অটোমেটেড চালান বা এ চালানব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মধ্যে শুল্ক-কর হার যৌক্তিক করার জন্য একটি ট্যারিফ পলিসি চূড়ান্ত করা হবে। এগুলো মূলত প্রশাসনিক উদ্যোগ।
এ বিষয়ে এনবিআরের সদস্য মইনুল খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভ্যাট খাতে ইএফডি মেশিন ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে কাজ করবে। এর মাধ্যমে ভ্যাট খাতের শৃঙ্খলা আসবে। ভ্যাট আদায়ের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে ইতিমধ্যে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করছি। তারা জানান, কাঁচামালের সরবরাহ কম। বৈশ্বিক ও স্থানীয় পরিস্থিতির কারণে উৎসে কর আদায় কমছে, তাই এখন তদারকি বাড়িয়ে রাজস্ব আদায়ের উদ্যোগ নিচ্ছি।’
মইনুল খান আরও জানান, বিভিন্ন কমিশনারেটের লক্ষ্য কতটা অর্জিত হলো, তা প্রতি মাসেই পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ভ্যাটের শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতেই এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এবারও ভ্যাট আদায়ে প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ হবে বলে মইনুল খান আশা করেন।
করদাতার ওপর সরাসরি প্রভাব
করদাতার সংখ্যা বাড়াতে এনবিআরের আয়কর বিভাগ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনকে টার্গেট করেছে। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, ব্যবসায়ী সংগঠন, বড় বড় বিপণিবিতান মালিক সমিতিসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনকে চিঠি দিয়ে জানতে চাইছে, এসব সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে কাদের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) আছে, কাদের নেই। যাঁদের নেই, তাঁদের টিআইএন নিতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
এভাবে গত ছয় মাসে প্রায় এক লাখের মতো নতুন করদাতা শনাক্ত করা গেছে বলে প্রাথমিক হিসাবে জানা গেছে। এ ছাড়া করদাতাকে রিটার্ন জমায় বাধ্য করতে ৩৮ ধরনের সেবা নিতে রিটার্ন জমার রসিদ দেখানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
২০২০ সালের পর আয়করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়নি। কর্মকর্তারা মনে করেন, এই সীমা বাড়ালে বিপুলসংখ্যক করদাতা করজাল থেকে বেরিয়ে যান, তাদের কাছ থেকে কর পাওয়া যায় না।
গত তিন বছরে কোভিড এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বেড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে করদাতার প্রকৃত আয় কমেছে। তবু করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি, যা করদাতার ওপর বাড়তি চাপ ফেলছে।
বিশ্বব্যাংকের ডিপিসির বাজেট সহায়তা পাওয়ার অন্যতম শর্ত ছিল—রপ্তানি খাতে কর রেয়াত কমাতে হবে। এর ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরের বাজেটে পোশাকসহ সব রপ্তানি খাতের ওপর উৎসে কর আগের মতো পুনরায় ১ শতাংশ করা হয়েছে।